কয়েক দিন ধরে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ চা-সমুচা-শিঙাড়া ও চপ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই বিদেশেও বাঙালির আড্ডার বিষয়বস্তু এখন চা-চপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য মহোদয় গর্ব করে বলেছেন, ‘টিএসসিতে এক কাপ চা, একটি সমুচা, একটি শিঙাড়া ও একটি চপ ১০ টাকায় পাওয়া যায়।’ ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে তাঁর এই বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়ে কাঁপছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
শায়েস্তা খাঁয়ের সস্তা-বিলাসে কেন মোহাবিষ্ট ঢাবি? ঢাবিতে মাসে ১৭ টাকা টিউশন ফি, হলের সিট ভাড়া মাসে ১৪ টাকা। টিউশন ও আবাসন মিলে প্রতি বছর ৩৭২ টাকা নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। অন্যান্য ফি মিলে একজন ছাত্র বছরে খরচ করে ৫-৬ হাজার টাকা। ভর্তি ফি বিভাগ ভেদে ১০-১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। শায়েস্তা খাঁ বেঁচে থাকলে লজ্জা পেতেন নিশ্চয়।
চলুন, একটু তুলনা করি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রেডে প্রতি বছর লাগে ৬৯ হাজার ৪৩০ ডলার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে আংশিক ও পূর্ণ বৃত্তি পায়। বাকিরা নিজ খরচায় পড়েন। অর্ধেকের আয় বাকি অর্ধেককে দেওয়া হয়। ইয়েলের ব্যয় শূন্য। ব্যবস্থাপনার কাজটা ইয়েল করে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফি ৪১ হাজার ডলার। এই পর্যায়ে বৃত্তিধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭৫ শতাংশ। এই বৃত্তির অধিকাংশ আসে গবেষণা অনুদান থেকে।
অনেকে বলবেন, ইয়েলের সঙ্গে ঢাবির বা আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা অবান্তর। ধরুন, ঢাবি বাংলাদেশের ‘ইয়েল’। তাহলে ঢাবির শিক্ষার্থীকে বছরে কত ফি দেওয়া উচিত? কমপক্ষে ৮০-৮৫ হাজার টাকা নয় কি? বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু টিউশন ও অন্যান্য (আবাসন বাদে) ফি বাবদ বছরে ১-২ লাখ (ন্যূনতম) টাকা দিতে হয়। আর ঢাবি শিক্ষার্থী প্রতি বছরে ব্যয় করে ন্যূনতম ৬০ হাজার টাকা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কে সে গৌরী সেন? সরকার না ঢাবি? টাকাটা নিশ্চয় জনগণের করের টাকা থেকে আসে।
বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুফতে পড়াশোনা করা যায়। সস্তায় পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা কী শিখছেন ও কী দিচ্ছেন, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুফতে পড়ার সুযোগই কিন্তু সব নষ্টের গোড়া। এটা বন্ধ করতে হবে। টাকাটা শিক্ষার্থী নয়, গৌরী সেনই দেবে। কিন্তু কীভাবে দেবে? কেন দেবে ও কাকে দেবে? কীভাবে খরচ করবে? কীভাবে অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তা ভেবে দেখা উচিত। ঢাবি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কি যথাযথ? সহজ উত্তর, ‘একেবারে না’। তাহলে কী করা যায়? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে, উপমহাদেশের ও বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে তুলনা করে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হোক।
শিক্ষার্থীদের পেছনে যে টাকাটা বিশ্ববিদ্যালয়, তথা সরকারের ব্যয় করে, তা তাদের টিউশন ফি বৃত্তি ও আবাসন ফি (স্টাইপেন) হিসেবে দেওয়া হোক। অনেকে বলবেন যেটা মাথা সেটাই ধড়। কিন্তু ব্যবস্থাপনার মুনশিয়ানায় মাথা ও ধড়ের পার্থক্য পরিষ্কার হবে। বিষয়টি অতি সাধারণ, নতুন নয়। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়টাই আমূল পরিবর্তন আনতে পারে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায়। সবাইকে গড়ে বৃত্তি না দিয়ে মেধা ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারে তা দেওয়া হোক। টিউশন ফি বৃত্তির ক্ষেত্রে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া হোক। আবাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা ও অভিভাবকের মাসিক আয়ের বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়া হোক। ভর্তির আবেদনের সময়ই বৃত্তি ছাড়া পড়বে কি না জিজ্ঞেস করা হোক। টিউশন ও আবাসন ফি ছাড়া যাদের পড়ার সামর্থ্য আছে, তাদেরকে বৃত্তি কার্যক্রমে নিরুৎসাহিত করা হোক। ঢাকা শহরে যাদের বাড়ি আছে, তাদের আবাসন বৃত্তি বিবেচনারই প্রয়োজন নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত কর্মচারী ও কর্মকর্তার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যত দূর সম্ভব ডিজিটালাইজড করা হোক। সম্ভাব্য ক্ষেত্র শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ তৈরি করা হোক। এতে শিক্ষার্থীদের যে অংশের দরকার, তারা কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পরিচালিত হয়, তা কিছুটা হলেও জানবে তারা। দায়িত্বশীলতা তৈরি হবে। ছাত্রাবস্থায় উপার্জন করতে শিখবে। মা-বাবার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারবে।
কোনো সেমিস্টারে একটি নির্দিষ্ট মানের ফলাফল না করতে পারলে বৃত্তি বাতিলের বিধান রাখা প্রয়োজন, যা বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে। তা ছাড়া উপযুক্ত কারণ (অসুস্থ) ব্যতিরেকে অনিয়মিত হলে বৃত্তি বাতিল হবে। তাতে শিক্ষার্থীরা বৃত্তি ধরে রাখার জন্যই নিয়মিত হবে ও ভালোভাবে পড়াশোনা করবে। ফেল করেও বছরের পর বছর হলে থাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুণঃভর্তি হওয়া, রাজনীতির নামে অপকর্ম করা বন্ধ হবে।
মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের টিএ ও আরএ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যায়। তাতে কর্মচারী ও কর্মকর্তা বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় কমবে। এমনকি শিক্ষকেদের ওপরও চাপ কমবে। তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুসরণ করা যেতে পারে। ভালো শিক্ষকদের একের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হোক। ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে ক্লাস্টার তৈরি করে ভাল শিক্ষকদের দ্বারা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া যায়। শিক্ষকদের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় কমলে উদ্বৃত্ত টাকা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি হিসেবে দেওয়া যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে অনেকে এখন ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে বাবার তালুক মনে করে। মুফতে পড়ার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বৃত্তি প্রথা চালু করলে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ব্যবহার করে বড়ভাই সাজার প্রবণতা চিরতরে বন্ধ হবে।
চলনে-বলনে, ফ্যাশনে-স্টাইলে পশ্চিমাদের অনুসরণে জাত যায় না, কেবল শিক্ষায় পশ্চিমাদের অনুসরণ করলে বাঙালির জাত যায়। শিক্ষা উপমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী দুজনে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। আশা করি তাঁরা বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন।
শিক্ষার্থীরা শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরে যেতে চায় না। ১০ টাকার চা-সমুচা-শিঙাড়া ও চপ নিয়ে গর্বিত হতে চায় না তারা। তারা আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। সস্তায় শিক্ষা দেওয়ার নামে মানহীন শিক্ষা জাতিকে পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বৃত্তি প্রথা চালু করা খুবই জরুরি। এতে সেশনজট ও তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গতিশীলতা আসবে, শিক্ষার্থীরা দায়িত্বশীলও হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব। চাই সদিচ্ছা। বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক ব্যবস্থাপনায় ফিরে এলে সত্যেন বোস ও কাজী মোতাহার হোসেনের মতো শিক্ষকও আসতে শুরু করবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারবে চা-সমুচা-শিঙাড়া ও চপের চেয়ে অধিকতর গৌরবের অংশীদার।
লেখক: পোস্টডক্টরাল অ্যাসোসিয়েট, ডিপার্টমেন্ট অব রেডিওলজি অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইমেজিং, ইয়েল স্কুল অব মেডিসিন, কানেকটিকাট