এই প্রশ্নটি আসতেই পারে যে, তিনি কেন বারবার পঠিত হবেন। কী আছে তাঁর কবিতায়? কেন তিনি বেঁচে থাকবেন? এর উত্তর আমি অনেকভাবে দিতে পারি। দিতে পারি তাঁর নিজের কথা দিয়েই। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, পাঁচটি বই থাকবে নিজের। আমাকে বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাতন বুঝো!’ তাঁর ডান হাতের পাঁচটি আঙুল তখন আমার দিকে বাড়ানো। আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। ২০১১ সালের বিকেল সেদিন ঝলক দেখিয়েছিল আমাকে। ‘তাহলে আপনার আরেকটি বই আসছে!’ ‘হ্যাঁ, সেটাই আমি চাই। কিন্তু পারব কী না জানি না।’
আমরা জানতাম একটা সময়ে তিনি পড়তেই বেশি ভালোবাসতেন। লেখাকে কষ্ট মনে হতো তাঁর। এরপরও আমরা তাঁকে সাহস জোগাতাম। বলতাম, ‘আপনার উপস্থিতি চায় আপনার পাঠক।’ তিনি বলতেন, ‘দেখি কী পারি।’
শহীদ কাদরী নেই। তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থটি বের হয়েছে। এটি প্রকাশ করছে দেশের খ্যাতিমান প্রকাশনী ‘প্রথমা’। পত্র-পত্রিকায় সংবাদও এসেছে। কিছু কবিতা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আগেই।
শহীদ কাদরী সব সময় ছিলেন সকল রক্তপাতের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রধান শত্রু ছিল গুপ্তঘাতক। এই চিত্র তাঁর শেষ দিকের লেখা কবিতায়ও আমরা পাই—
‘হন্তারকদের অস্ত্রের ছায়ায় লালিত আমরা
প্রত্যেকে আজ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষ।
এমন এক দুঃসময়ের মধ্যে আমরা
বসবাস করছি, যখন
দেশে-দেশে উত্থান ঘটছে আণবিক অস্ত্রের
আমাদের শেষ গানগুলো এখুনি গাইতে হবে—
মানবিক বন্ধনের, প্রেমের,
অপার ভালোবাসার গানগুলো গাইতে হবে এখনই
অন্ধকার সময় থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য
গানগুলো আমাদের সম্বল।
রাত্রি যেমন নক্ষত্রের পক্ষে
গাছগুলো যেমন নতুন পত্রালির উত্থানের পক্ষে
নদীগুলো যেমন কল্লোলিত ধ্বনির পক্ষে
ফাঁসির আসামি যেমন ক্ষমাপ্রাপ্তির পক্ষে
আমাদের গানগুলোকে
দাঁড়াতে হবে সন্তানসম্ভবা মহিলাদের পক্ষে
পর্বতচূড়া আর সমুদ্রের বিস্তারের পক্ষে
এই গ্রহের প্রতিটি
ঘাসের শিখার পক্ষে।
এখন সেই দুঃসময়, যখন
আমাদের গাইতে হবে
আমাদের শ্রেষ্ঠ গানগুলো’
[ আমাদের শেষ গানগুলো ]
অনেক কেন’র জবাব খুঁজেছেন তিনি তাঁর কবিতায়। তাঁর পঠন তালিকায় ছিলেন শার্ল বোদলেয়ার, আর্তুর র্যাঁবো, টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ডব্লিউ এইচ অডেন, ব্রায়ান প্যাটেন, আড্রিয়ান হেনরির মতো কবিরা। বিশ্বসাহিত্যের অনেক সিঁড়ি দিয়ে হেঁটেছিলেন তিনি। ‘হাংরি জেনারেশন’ কিংবা ‘বিট জেনারেশন’-এর মতো কাব্য-বিবর্তনকে তিনি দেখতেন বিপ্লব হিসেবে। মানুষের জয় হবেই—এই প্রত্যয় ছিল তাঁর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
‘না। উত্তর জানে না কেউ,
না ওই সোনালি সোমত্ত গাছ, না ওই যে
অ্যাকুয়ারিয়ামের লাল, নীল, রুপালি মাছ।
এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও
উত্তর ছিল না জানা।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কেন
লাশকাটা ঘরে যাবে,
হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠবে
কোনো কোনো রাষ্ট্রনায়ক,
গায়ক পক্ষীরাও নিহত হবে শখের শিকারির
অমোঘ নিশানায়
ইতিহাসও নিরুত্তর। কেন নৃপতিরা
সাম্রাজ্য বিস্তার করেন!
কেন আমার পুত্রের পুত্ররা
ফড়িংয়ের ডানা ছেড়ে দেয় বাগানের
ঘাসের বিস্তারে আর
যুদ্ধফেরত স্বাধীনতার
ক্রাচে ভর দেওয়া সৈনিকেরা লাফিয়ে লাফিয়ে
ফড়িংটাকে হাঁটতে দেখে
সোল্লাসে তালি
বাজাবে’
[ উত্তর নেই ]
শহীদ কাদরী ছিলেন খুবই আড্ডাবাজ মানুষ। মনে পড়ছে, কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় যখন আমার প্রথম কবিতাটি মনোনীত হওয়ার চিঠি আসে, সেদিন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘চলে এস আড্ডা দিই।’
তিনি আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। সেই সঙ্গে উঠে আসত লেখালেখি, রাজনীতিসহ কত কিছু। নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন; রাখতে ভালোবাসতেন। তিনি নিজের লেখালেখি নিয়ে উৎসাহ না দেখালেও বাংলাদেশের বর্তমান লেখকদের সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ দেখাতেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে তিনি নিজেকে যতই গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, ততই পাঠক জানতে চাইত তাঁর কবিতার বিষয়ে। হ্যাঁ তিনি তাঁর ‘সেল্ফ কনফিডেন্স’ রেখে গিয়েছেন কবিতায়। পড়ুন এই কবিতাটি—
‘কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর তোমার আস্থা নেই আর
তুমি বলবে: ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
করাই হচ্ছে নিয়ম’
যদি বলি, শপথ এই প্রবল রাত্রির বৃষ্টির
শপথ, শপথ আমাদের
গানপাগল নদীগুলোর শপথ
বৈশাখের আকাশের
কালো মেঘগুলোর শপথ
তুমি বলবে: ‘এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না’
তাহলে গ্রহণ করো
এই গোলাপটি।
এই জগদ্বিখ্যাত পুষ্প কথার বরখেলাপ করে না
সে তার কথা রাখবে।
সে কিছুটা সৌরভ বিলিয়ে
ম্লান হয়ে অস্ত যাবে তোমার
হাতের তালুতে, প্রিয়তমা।
কেউ তো তার কথা রাখবে।’
[ প্রতিশ্রুতিগুলো ]
আমি আমর বিভিন্ন লেখায় বলেছি, তিনি ‘রায়ট’ দেখেছেন। ওই দাঙ্গা থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অনেক হত্যাকাণ্ড তাঁকে কাঁদিয়েছে। তা অকপটে স্বীকার করেছেন বহুবার। এমন আকুতি এসেছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। আমি মনে করি তাঁকে জানার জন্যই তাঁর কবিতাগুলো পড়া প্রজন্মের গুরুদায়িত্ব।
‘বহুবার আমি বাল্যকালে ফড়িংয়ের ডানা ছিঁড়ে
ছেড়ে দিয়েছি ফুটবল খেলার মাঠে। ঘাসের মধ্যে
ফড়িংটা লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে গেছে
ক্রাচে ভর দেয়া আহত সৈনিকের
মতো তার ভবিতব্যের দিকে। এয়ারগানের
ট্রিগার টিপে ছড়িয়ে দিয়েছি ছররা
কাকগুলোর শরীরে। কা-কা করতে করতে
সেই সব কাক লুটিয়ে পড়েছে কলকাতার
ফুটপাতে। এখন যদিও আমি পিঁপড়েদের
পক্ষ অবলম্বন করছি, একদা অসংখ্য
পিঁপড়ে পিষে গেছে নটিবয় শুয়ের তলায়।
এই সব হত্যার স্মৃতি হঠাৎ হানা দিল
সেদিন দুপুরবেলায়, আমার ছায়াচ্ছন্ন কৈশোরে।’
[ হত্যার স্মৃতি ]
মানুষের আড়ালে কি আরেক মানুষ থাকে? কিংবা জীবনের আড়ালে আরেক জীবন? এমন প্রশ্ন তাঁকে বহুবার করেছি। বলেছেন, মানুষ মাত্রেই দুটো ইতিহাস। প্রেম যেমন চিরন্তন নয়, তেমনি জীবনও আলোকিত নয় শুধু। একটি প্রাণ সমাধিস্থ হওয়ার সাথে সাথে অনেক ঘটনা, অনেক ইতিহাসই সমাহিত হয়ে যায়। তা কেউ জানে না। জানবে না। জানতে পারবেও না। কবিতায় তাঁর আখ্যান—
‘আমাদের প্রত্যেকের মাংসের গভীরে
বসবাস করেন
একজন গায়ক পক্ষী।
একদিন
হঠাৎ বাতাসে
উড্ডীন হয়ে
কোথায় যেন চলে যান
সম্ভবত অন্য কোনো
সতেজ বৃক্ষের ডালে। আমাদের মৃত্যু হয়।’
[ মৃত্যু ]
শহীদ কাদরীর একান্ত প্রার্থনা ছিল তাঁর স্বদেশ নিয়ে। তিনি তাঁর মাটির উত্থান চাইতেন সব সময়। চাইতেন, বাঙালি এগিয়ে যাক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। দুষ্ট রাজনীতি থেকে মুক্তি পাক বাংলাদেশ। তিনি মনে করতেন, মানুষের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠধ্বনিই পারে সকল অপশক্তিকে রুখে দিতে। এমন দিন একদিন বাংলাদেশে আসবে—এটাই ছিল তাঁর শেষ প্রত্যাশা।
‘আমার পেছনে যতগুলো সাঁকো ছিল
একে একে ভেঙে পড়ছে।
এই ভাঙনের শব্দ থেকে আমি
কেবল নিস্তার চেয়ে
প্রার্থনা করেছি তোমার কণ্ঠস্বরের উত্থান
অনেক হত্যার সাক্ষী আমার আহত চোখজোড়া
তাদের অন্বিষ্ট আজ
বন্য মোরগের মতো গহন বনের দুর্গ,
যেখানে শিকারি তার
বন্দুকের নল নিয়ে পৌঁছুবে না কোনো দিন।
সেইমতো আমাকে অন্তত দাও
তোমার চুলের তিমিরাচ্ছন্ন আড়াল।
আমাকে শোনাও
ইমন কল্যাণ কিংবা আশাবরি—
আমাকে নিস্তার দাও ভাঙনের শব্দ থেকে
আমাকে নিস্তার দাও
প্রতিদিন কয়েক শ মানুষকে
গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে
কেন যে আইখম্যান আপন বাসায় ফিরে এসে
নিপুণ আঙুলে বাজাতেন তাঁর
লিভিং রুমের গ্র্যান্ড পিয়ানোটিকে?
মৃত্যুগামী মানুষের আর্তনাদ থেকে
হন্তারকদের প্রতিনিধি আইখম্যানও কি চেয়েছিল
নিস্তার একদা?
স্বীকার করছি আমি
একদা শিকারিদের সঙ্গে বনে বনে
ঘুরেছি আমিও; কিন্তু আমার স্বজন কিংবা শত্রু
কেউ নিহত হননি
আমার অপাপবিদ্ধ হাতে।
আমি আর কোনো ভাঙনের শব্দ শুনতে চাই না
আমাকে তোমার
সজল চোখের পল্লবের ছায়ার নিচে
একটু দাঁড়াতে দাও।
আমাকে নিস্তার দাও ভাঙনের শব্দ থেকে।
ছুরি-বেঁধা মানুষের চিৎকার
বন্দুকের গুলির শব্দ
ছররা খাওয়া কাকের আর্তনাদ
কারও ঘর ভেঙে পড়ার
মর্মঘাতী আওয়াজ, দেশে দেশে সৈনিকদের
কুচকাওয়াজ, আর কিছু জাঁহাবাজ—
রাজনীতিবিদের উল্লাস ইত্যাদি করাল ধ্বনি
থেকে আমাকে নিস্তার দাও।’
[ প্রার্থনা করেছি আমি উত্থান তোমার কণ্ঠস্বরের ]
শহীদ কাদরী হাজার বছর বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়। আরও অনেক গবেষক তাঁর কবিতার মর্মমূলে পৌঁছে যাবেন তাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে। যে কবি বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার খোঁজে, কী ছিল তাঁর গন্তব্য! শোনা যাক তাঁরই ভাষ্য—
‘অথচ আমার
হৃৎপিণ্ডে এখনো বেজে চলেছে জলের পর ঘর-ফেরা
ছিপ নৌকোর বৈঠার মতন! ‘ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন’
তিন তিনটে মহাদেশ থেকে
অন্তত ছ’বার উড়োজাহাজের টিকেট কিনেও
তোমাদের উঠোন পেরিয়ে
নিজস্ব আটচালার দিকে যাত্রা সাঙ্গ হয়নি এখনো।
তোমরা বিশ্বাস করো
ছয় বেহারার পালকিতে আমিও
চেপেছি একদা এবং ‘হুমনা হুমনা’
করতে করতে সেই গাঁয়ের নদীর
কিনার অবধি
পৌঁছে
‘পৃথিবীকে মায়াবী নদীর তীরে এক দেশ বলে
আমারও হয়েছে মনে’
কিন্তু আমি
সেখানে আমার গাঁ কিংবা শহর
কিংবা বাড়ি কিছুই এখনো খুঁজে পেলাম না।’
[ নিরুদ্দেশ যাত্রা ]
কবির বাড়ি থাকে না। বাউলদের ঘর থাকে না। আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, এক বাউল বাস করত তাঁর ঘরের পাঁজরে। তিনি খ্যাতি চাইতেন না। তিনি মানুষের ভালোবাসা চাইতেন।