শমশেরনগর বিমানবন্দরে ক্যাম্প স্থাপন করতে বললাম আমার লোকদের। ১৯৫৮ সাল থেকে কোম্পানির অর্ধেকের বেশি জওয়ান ও এনসিওদের চিনি। ব্যাটমান বাতেন চৌধুরীকে আমার জন্য ওয়াচ টাওয়ার বেড রুম রেডি করতে বললাম। চারদিক থমথমে। দোকানপাট বন্ধ। জমাদার সাফিন গুল অনেক পুরোনো বন্ধু। সে নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের পুলিশ থেকে ১৯৫৮ সালে ইপিআরে এসেছে। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা টকটকে লাল চেহারার এক পাঞ্জাবি মেজর উইং কমান্ডার রাতে ওর ক্যাম্পে মদ্যপ অবস্থায় এসে খুব বকাঝকা করে অপমানিত করতে চেয়েছিল। হঠাৎ গুল ক্ষেপে গিয়ে মেজরকে আটক করে রেখেছিল। তাই সুবেদার থেকে পদাবনতি পেয়ে জমাদার হয়ে গেছে। বহু পুরোনো বন্ধু। সব সময় ছুটিতে গেলে আমার জন্য পেশওয়ার থেকে চপ্পল নিয়ে আসত। রানার গোলাম রসুলকে দিয়ে তাকে তার কাছে সালাম পাঠালাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম, বুঝলাম ওরা সব কয়জনই শঙ্কিত ও একটু ভীত।
সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাবিলদার মেজর ফরহাদকে ডাকলাম। সিগারেট খেতে খেতে রানওয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বেশ দূরে গিয়ে সব সংবাদ জানতে চাইলাম। ফরহাদ আমার সঙ্গে খুলনা ৫ উইং, রামগড়ে কাসালং ফায়ারিংয়ে ছিল। লাতুতে আমার কোম্পানির কোঁত নায়েক ছিল। বাঙালি হাবিলদার মেজর সে সময় খুব কমই হতো। পাঞ্জাবিরা সব ভালো ভালো পোস্ট নিয়ে নিত। গেঁড়াই বাজী নামে অতীব পরিচিত শব্দ। ১৩ বছরে এখনো ইপিআরের পলিটিকস বুঝে উঠতে পারিনি। ফরহাদ বলল, স্যার অবস্থা কিন্তু মোটেও ভালো না। পাঞ্জাবি, বালুচি, পাঠানগুলাকে কোনোভাবেই গার্ডপোস্টে বা বাইরে পাঠানো যাবে না। স্যার পাঞ্জাবিরা কিছু একটা করবেই করবে। ভীষণ হারামি এরা। আমাদের এই আন্দোলন কোনোভাবেই বরদাশত করবে না।
জিজ্ঞেস করলাম, ওয়ারলেস সেট কি সেট করা হয়ে গেছে? বলল, স্যার রাত ৯টার মধ্যে হয়ে যাবে। বললাম, এরিয়া পেট্রল ছাড়াও রুমে গার্ড দিতে, আমার ওয়াচ টাওয়ারে দুইটা হাতিয়ার, আমার থ্রি এইট রিভলবারে ২৪ রাউন্ড গুলি আর গোলাম রসুলকে বিস্তারা লাগাতে বল। কোঁতের দরজায় চার পায়া দিয়ে ব্লক করে ওর বিছানা লাগাতে বললাম। মূল ফটকে ল্যান্স নায়েক আরব আলীকে গার্ড কমান্ডার করার নির্দেশ দিলাম। সে বলল, স্যার সিপাহিরা তাদের সঙ্গে কথাও বলতে চায় না। সম্পর্ক প্রায় ভঙ্গুর। জওয়ানেরা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ও তাদের ঘৃণা করে। বারবার তাকে সাবধান করে দিলাম, যাতে কোনো রকম অঘটন না ঘটে।
ফরহাদকে বিদায় দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালাম আর পায়চারি করতে করতে অনেকক্ষণ ভাবলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাতটা ১১ মিনিট। বললাম, বাজারে একটা দোকানও খোলা নেই। অনেক কুকুর করুন সুরে কাঁদছে। দূরে কোথাও ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলাম। জুড়িতে মান্নান কোম্পানি কমান্ডার, লাতুতে কোবাদ আলি আর তামাবিলে বি আর চৌধুরী। বাকি কোম্পানি কমান্ডার সবাই পাঞ্জাবি। আরও এক-দুজন বাঙালি থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু ওই মুহূর্তে আর কারও নাম মনে করতে পারছিলাম না। কেবল ঢাকা থেকে বদলি হয়ে আসলাম-১৬ উইং ইপিআর রেইজ করে। সদ্য ঘোষণা হয়েছে, আমাকে পিপিএম (পাকিস্তান পুলিস মেডেল) নাকি দেওয়া হবে। সুবেদার মেজর রব আমাকে এরই মধ্যে রাতে গোপনে নিয়ে গিয়েছিল নেতার সঙ্গে। কী বিশাল তার ব্যক্তিত্ব ও কণ্ঠস্বর। বললেন, রেডি থেকো, ওদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যাবে না। বুঝলাম, সুবেদার মেজর রবের সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ আছে। রব সেন্ট্রাল সুবেদার মেজর, ইপিআরের ক্ষমতাধার কর্মকর্তা। প্রথম দেখায়ই অপরিসীম আনুগত্য নিজের অজান্তেই সমর্পণ করে। রব সাহেব খুব সাবধান থাকতে বললেন। আর কাউকে ওই বৈঠকের ব্যাপারে না জানাতে বলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্লেভ লেবার হিসেবে এলাকার জনগণকে দিয়ে বিমানবন্দরটি বানানো হয়েছিল। মেইন ভবনটাই ক্যাম্প। শেষ প্রান্তে সিঁড়ি ঘর। ওপরেই ওয়াচ টাওয়ার। দুটি গোলাকৃতি রুম। একটা বাথরুমও আছে। এক রুমে আমি আর অন্য রুমে ওয়ারলেস সেট অপারেটর মোস্তাফা আর বাতেন। সোজা ওপরে উঠে এসে মোস্তাফাকে জিজ্ঞেস করলাম, কত দেরি? বলল, স্যার ২০ মিনিটেই ‘ওকে’ হবে সব। বললাম, আমাকে মান্নান অথবা বি আর চৌধুরীকে পারলে মিলিয়ে দিতে। পাকিস্তান আমলে একমাত্র ইপিআরের কাছেই সারা দেশের (পূর্ব পাকিস্তান) সব ইপিআর ক্যাম্পে টর-এ-টাঁককা টেলিগ্রাম ছিল, যা দিয়ে সারা দেশের যেকোনো ক্যাম্পে যোগাযোগ করা যেত। পোশাক আর খুললাম না। নিচে নেমে বললাম, রোল কল ডাকো। ফল ইন কর সবাইকে। প্রহরী ছাড়া সবাই একত্রিত হলো। একটা ছোট বক্তৃতা দিলাম। বললাম, আমরা সরকারি চাকরিজীবী। সকালে টহলে গেলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেন কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করবেন না।
সিপাহি বকর আর সিপাহি দারু মিয়া দুজনই সিলেটী। বললাম, তোমরা দুজন সকালে মুফতি ড্রেস লাগায়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে। রোল কল ডিসমিস করতে না করতেই মোস্তফা এসে বলল, স্যার রেডি। মান্নান সাহেব কথা বলতে প্রস্তুত। উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে সেটের কামরায়। মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বাংলা, কুমিল্লা, ঢাকাইয়া ও কুট্টি ভাষায় কথা বললাম। সেও খুবই আতঙ্কিত-কী হবে, কী করব? সে আমাকে পরিষ্কারভাবে বলল, চৌধুরী সাবধান, টুআইসি ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল তোমার কোম্পানি ভিজিট করতে আসছে। এটি খুবই রহস্যময়, কেয়ারফুল। আমি ওকে বললাম, আমি সিগনাল সেটের পাশেই থাকব। কোনো রকম খবর পেলেই যেন আমাকে জানায়। কথা বলতে বলতেই দুরে কুকুরের কান্না শুনতে পেলাম। নিদারুণ করুন সুরে অনেক কুকুর কাঁদছে। হাবিলদার মেজর ফরহাদকে ডেকে বললাম, তিন সিপাহি আর একজন এনসিও হাতিয়ারসহ ১০ মিনিটের মধ্যে তৈরি করতে।
চতুর্দিকে কেমন যেন থমথমে পরিস্থিতি মনে হলো। বাজারের প্রহরী কয়েকটা উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেন জানি সেই ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার দিনগুলোর কথা মনে পড়তে লাগল। একবার বাচ্চাদের চেহারা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। বসে বসে উইলিস অ্যান্ড ব্রিস্টলের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন লাগালাম। অনেক দূরে দেখতে পেলাম, চা বাগানের আলো প্রজ্বলিত বাংলো আর ফ্যাক্টরির চিমনিগুলো। নিয়ন আলোয় অন্ধকার সেই পারিপার্শ্বিকতার মাঝে মনে হলো যেন গভীর রাতে হুগলি নদীর মাঝে কোনো ইংরেজ কোম্পানির প্রমোদ তরি ভেসে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব সেই দৃশ্য।
অনেক দূরে রাতের আঁধারির মধ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, খাসি পাহাড়ের ছায়াগুলো। ভাবলাম, সকালে একবার মণিপুরি বস্তিতে যাব। চাতলাপুর ও আশপাশের এসব এলাকা আমার খুবই পরিচিত। কয়েক বছর আগে আমি এই এলাকা ইপিআরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলাম। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কুলাউড়া পর্যন্ত। কমলগঞ্জ-মনু-ভানুগাছ এলাকার সব মণিপুরি বস্তির ব্রাহ্মণ আর মন্ত্রীরা সবাই আমার অতি পরিচিত। ভাবলাম কাল সময় পেলে পিকআপটা নিয়ে এক চক্কর ঘুরে আসব। আর প্রিতিমপাশার নবাব সাহেবকেও হ্যালো বলে আসব। অনেক গল্প করতে পছন্দ করেন। লাঠি টিলা যুদ্ধের সময় অনেক সাহায্য করেছিলেন। এই এলাকার ইতিহাস সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি নবাব সাহেবের কাছ থেকে। আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে হাতের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না।
হঠাৎ ফরহাদের ডাকে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। সে বলল, স্যার, আপনার কথা মতো এক টিন পেট্রল পার্টি রেডি। শুনেই নিচে সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। সামনে দাঁড়ান চারজনকে আস্তে করে ডেকে বললাম, তোমরা চারজন বাজারে ছদ্মবেশে টহল দেবে প্রথম প্রহর পর্যন্ত। কোনো রকম সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সোজা ক্যাম্পে দুজনকে পাঠিয়ে দিবা। এক মাইলের বেশি দূরে যাবে না। ওরা সোজা ফটকের পাহারাদারদের বলেই সবার ঘুম ভাঙিয়ে টাওয়ারে পজিশন নিবে। বাকি দুজন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর বিমানবন্দরের অন্য পাশ দিয়ে ঢুকবে। আবার মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, এসেই যেন আমার কাছে রিপোর্ট করে। ওদের বিদায় দিলাম। নায়েক বাছিত মিয়া আমার ফাইভ উইংয়ের পরিচিত। বললাম, বাছিত খুব সাবধান। পরিস্থিতি সন্দেহজনক। ওই পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদারকে কেন জানি আর বিশ্বাস করতে পারছি না। মনটা কেমন যেন বিষিয়ে গেছে ওদের ওপর। ইতিমধ্যে ২৫ মার্চ আমার ঘড়িতে সকাল তখন প্রায় ২টা পাঁচ বাজে।
(প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক চৌধুরীর ৪৬ বছরের পুরোনো ডায়েরি অবলম্বনে)