পাখির উড়তে যাওয়া দেখে যার উড়ার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল, ২৯ আগস্ট বিকেলে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার অফিসে এমন এক আলোকিত নারীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি শুধু নিজেকেই আলোকিত করেননি। তার আলোতে আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীজুড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার গৌরব নিয়ে ছুটি চলছেন এই নারী। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করছেন পৃথিবীজুড়ে। আমরা সবাই পতাকা গার্ল নামে জানি তাঁকে। তিনি হলেন বিশ্বজয়ী নাজমুন নাহার সোহাগী। বাবা তাঁকে আদর করে সোহাগী বলেই ডাকতেন।
নাজমুনকে অল্প সময়ে যতটুকু চিনেছি, তিনি সোহাগ করার মতোই একজন। সংগ্রাম করছেন, কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। সড়ক পথে একা একা পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে পথ পাড়ি দিয়েছেন। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ, সমুদ্র, মরুভূমিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। তিনি একা একা পৃথিবীর ১৩০টি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছেন। কখনো সাহারার মরুভূমি, কখনো বিপৎসংকুল আফ্রিকান জঙ্গল আবার কখনোবা সমুদ্রের তলদেশে গেছেন। গেছেন এক শ বছর বৃষ্টি না হওয়া চিলির আতাকামাতেও। নাজমুন নাহার পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই ভ্রমণ করেছেন সড়ক পথে একা একা। এ তালিকার মধ্যে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি দেশ। ইউরোপ ও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ!
নাজমুনের সঙ্গে গল্পের শুরুতে জানতে চাইলাম, আপনার দেশ ভ্রমণের ইচ্ছে কীভাবে কখন থেকে হলো। তিনি খুব মিষ্টি হেসে বললেন, ‘যখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি তখন থেকে। তিনি শবে বরাতে নামাজ পড়ে সারা রাত আল্লাহর কাছে দোয়াও করেছিলেন, তিনি যেন বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন। তাঁর বাবা সেই দোয়া শুনে প্রাণ ভরে হেসে তার জন্য দোয়া করেছিলেন। তার স্বপ্ন যেন পূরণ হয়।
ছোটবেলায় বাড়ির পাশের মাঠে পাখি ধরতে চাইলেই পাখি উড়ে যেত আকাশে। বললেন, তখন আমার মনে হতো আমিও যদি এভাবে উড়তে পারতাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা, আমি যদি বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারতাম। ছোট থেকেই আমি মানচিত্র দেখলে তাকিয়ে থাকতাম। কোন দেশের সঙ্গে কোন দেশ লেগে আছে তা দেখতাম। কোথাকার মুদ্রার নাম কি? রাজধানী কোনটি? এগুলো দেখে দেখে ভেতরে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতো যে একদিন আমি বিশ্বভ্রমণে যাব।
ছোট বেলায় অনেক গল্পের বই পড়তেন। বিভিন্ন দ্বীপের গল্প শুনতেন। তখন থেকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। তার বাবার মুখেও বিভিন্ন দেশের গল্প শুনতেন। মিসরের গল্প, আরও অনেক দেশের গল্প। তার দাদাও ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত আরবের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। সেই সব গল্প শুনে তার বিভিন্ন দেশ দেখার শখ হয়েছে। তার ভেতর থেকে সব সময় একটা কথাই আসত, তার জন্মই হয়েছে ভ্রমণের জন্য। তিনি তার পঞ্চম শ্রেণির প্রধান শিক্ষক আমানত উল্লাহ স্যারের কথাও মনে করেছিলেন। যিনি তার ওই বয়সে বিভিন্ন দেশের ম্যাপ জোড়া লাগানো দেখে খুশি হয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন, তুমি একদিন অনেক বড় হবে।
নাজমুনের এই ইচ্ছে পূরণে তিনি ছোট বেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। বিভিন্ন সংগঠন যেমন গার্লস গাইড, রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। ওই বয়সে প্রথম সীতাকুণ্ড পাহাড়ে ওঠেন। ওই পাহাড়ে ওঠা তাঁকে অনেক অনুপ্রেরণা জোগায়। ওই খানে প্রথম শিখেছিলেন মানুষকে সাহায্য করার। প্রতিদিন অন্তত একটা ভালো কাজ করা। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি তার ইচ্ছের জন্য স্বপ্ন দেখতেন। ২০০০ সালে ভারতের ভূপালের পাঁচমারিতে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বের ৮০ দেশের ছেলেমেয়ের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন!
১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন পূর্ব আফ্রিকার জিম্বাবুয়েতে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ওপর গত বছরের ১ জুন। ১২৫তম দেশের মাইলফলক করেন নাইজেরিয়া লাগোস শহরে গত ১৩ জানুয়ারি। ১৩০তম দেশ হিসেবে ভ্রমণের রেকর্ড কানাডায় গত ২৩ আগস্ট। তাঁর জন্য এই ভ্রমণ এত সহজ কিছু ছিল না। তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর পৃথিবীর পথে পথে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা আমাদের লক্ষ্য কোটি নারীকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নারীদের কৌশলী হতে শেখাবে, শুধু তাই নয়, ভয়হীন কীভাবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। সেই আলপনা অঙ্কিত করে যাচ্ছেন আমাদের বিশ্বজয়ী পতাকা কন্যা নাজমুন নাহার! যাত্রা পথে তিনি মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছেন। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে রক্তাক্ত হয়েছেন। পোকা–মাকড়ের কামড় খেয়েছেন আফ্রিকার জংলি পথে। অন্ধকারে অচেনা শহরে পথ হারিয়েছেন।
তিন মাস আফ্রিকায় আলু খেয়ে ছিলেন। কখনো না–খেয়ে ছিলেন! কখনো কাঠের মধ্যে, কখনো পাথরের ওপর, কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে জঙ্গলে তাঁকে ঘুমাতে হয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে! কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে ঘুমাতে হয়েছে!
নাজমুন নাহার ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছেন ইতিমধ্যে! দেশি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছেন। অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তার যুগান্তকারী বিশ্ব অভিযাত্রার জন্য! কারণ, তিনি পৃথিবীব্যাপী বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। পতাকার সম্মানকে তিনি সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরার জন্য হেঁটেছেন পৃথিবীর দুর্গম থেকে দুর্গমতর পথে!
সব সময় বাংলাদেশ সফরের শত ব্যস্ততার মাঝেও দেখা গেছে, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবার বিতরণ করেছেন। ছুটে গেছেন বাচ্চাদের বিভিন্ন স্কুলে তাদের স্বপ্ন দেখানোর জন্য। পৃথিবীর গল্প শোনানোর জন্য!
চট্টগ্রামে রেড ক্রিসেন্টের প্রোগ্রামে নাজমুনকে দেখা গেছে, তাঁর পৃথিবীর গল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে উৎসাহ দিতে। শুধু বাংলাদেশে নয়, তিনি পৃথিবীব্যাপী ও তাঁর যাত্রাপথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে তুলে ধরেন তাঁর বিশ্বভ্রমণের কথা। বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের কথা। সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন ২০০৯ সালে! দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘হিউমান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া’ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন ২০১৫ সালে! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ২০০৪ সালে!
নাজমুন নাহার ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ উপাধি পান গত বছরের ১ জুন। তাঁর বিশ্ব অভিযাত্রার মাইলফলকের সম্মাননা স্বরূপ জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়েনার তাঁকে এই উপাধি দেন। তিনি নানা সম্মাননাও পেয়েছেন নানা সময়ে। অনন্যা সম্মাননা পান ২০১৮ সালে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল, জনতা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, তিন বাংলা সম্মাননা পান। পেয়েছেন রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড।
অভিযাত্রার সঙ্গী হিসেবে নাজমুন ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাকে নিয়ে ঘুরছেন পৃথিবীর ১৪টি দেশ! নাজমুন নানা সময়ে নানা উপাধিও পেয়েছেন। ২০১৮ সালে সড়ক পথে একা একা দুঃসাহসিক অভিযাত্রার জন্য ‘তারুণ্যের আইকন’ উপাধি পান!
নাজমুন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক নতুন পথ সৃষ্টি করে দিয়ে যাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলেন। সে থেকেই ভ্রমণই তার নেশা। উৎসাহ দিয়েছিলেন তার বাবা। বাবার অনুপ্রেরণায় ডানা মেলেছেন শৈশবেই। উড়ছেন এখনো। লাল–সবুজের পতাকাকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রামে চাপা পড়েছে তার সংসার স্বপ্নও। বিশ্বরূপ দেখতে গিয়ে মানুষের মাঝে পরিচয় করে দিয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে। দেশ-দেশান্তরে শিশুদের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন দর্শনের শান্তির বার্তা।
নাজমুন নাহারের বিশ্ব অভিযাত্রার লক্ষ্য ২০০টি দেশে বাংলাদেশের পতাকাকে পৌঁছে দিয়ে এক অনন্য রেকর্ড গড়া। এর মাধ্যমে পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে তুলে ধরতে চান। এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর পৃথিবীর পথে পথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের লাখ কোটি নারীকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নারীদের কৌশলী হতে শেখাবে! স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনাও করে যাচ্ছেন আমাদের বিশ্বজয়ী পতাকা–কন্যা।