লং আইল্যান্ডে শিল্পাঙ্গনের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন

শিল্পাঙ্গনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সংগীত শিল্পীরা। শিল্পাঙ্গনের সংগীত পরিবেশনা দুটি পর্বে উপস্থাপিত হয়
শিল্পাঙ্গনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সংগীত শিল্পীরা। শিল্পাঙ্গনের সংগীত পরিবেশনা দুটি পর্বে উপস্থাপিত হয়

সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পাঙ্গনের উদ্যোগে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে ২৮ এপ্রিল দিনব্যাপী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদ্‌যাপিত হয়েছে।
লং আইল্যান্ডের ২০১ লেভিটটাউন পার্কওয়ে, হিক্সভিলে অবস্থিত লেভিটটাউন কমিউনিটি হলে দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরামহীন চলে এ অনুষ্ঠান। তারকা শিল্পীদের উপস্থাপনা উপভোগ করেন হলভর্তি দর্শক।
শিল্পাঙ্গন ‘সেন্টার ফর বাংলা ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কস ইন্‌ক’ হিসেবে নিউইয়র্কে একটি অলাভজনক ও আয়করমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যা ধর্ম, বর্ণ ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে বাংলায় সৃজনশীল চর্চায় নিমগ্ন রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ ও শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে আদান প্রদানও শিল্পাঙ্গনের অন্যতম লক্ষ্য।
দুপুর ১২টায় বৈশাখী মেলা দিয়ে শিল্পাঙ্গনের নববর্ষ উৎসবের সূচনা হয়। মিলনায়তন চত্বর বৈশাখের সাজে সজ্জিত হয়েছিল। লোকজ আলপনা ও পোস্টারে শোভিত করা হয় মঞ্চ ও দেয়াল। বিশেষ লক্ষণীয় ছিল ইটের নকশায় তৈরি শিল্পাঙ্গনের বিশাল তোরণ, কুঁড়েঘর, বটবৃক্ষ, রিকশা, ঘুড়ি ইত্যাদি। মঞ্চসজ্জার নকশা করেন টিপু আলম। আলপনা ও সাজসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন আহমেদ নাসিম, তারিক, নজরুল ইসলাম, ইকবাল ইসলাম, সোনিয়া হক ও মাসুদুল ইমাম।
মিলনায়তনের এক পাশে ছিল গোয়ালন্দ ভর্তা ঘর নামে বৈশাখী খাবারের আয়োজন। পাশাপাশি বাঙালি পোশাক যেমন, শাড়ি, সালোয়ার কামিজ ও গয়নার পসরা সাজিয়ে বসে বিভিন্ন বিপণন প্রতিষ্ঠান।
দুপুর দুইটায় বাংলা নববর্ষ উৎসবের শুভ উদ্বোধন করা হয় বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে। সাঈদা হোসেন মৌয়ের উপস্থাপনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল শিশু, কিশোর ও বড় শিল্পীদের সমন্বয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রা শুরু হয় মিলনায়তনের প্রবেশদ্বার থেকে। ঢাক ঢোলের বাদ্যে বর্ণাঢ্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা মিলনায়তন প্রদক্ষিণ করে মঞ্চে ওঠে। বাংলাদেশ ও আমেরিকার জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে শিল্পাঙ্গনের শিল্পীরা। এরপর মঞ্চ আলোকিত করে ওঠেন বাংলা আধুনিক ও লোক সংগীতের পুরোধা শিল্পী দুলাল ভৌমিক। দুলাল ভৌমিককে শিল্পাঙ্গনের পক্ষ থেকে আকতার কামাল উত্তরীয় প্রদান করেন। এরপর ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানের সঙ্গে প্রধান অতিথি মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে নববর্ষ উৎসবের উদ্বোধন করেন। আমর আশরাফের স্বাগত বক্তব্যের পর শিল্পী দুলাল ভৌমিক সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান।
এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। একক নৃত্য পরিবেশন করেন নুসায়বা কবির ও সামায়রা মাহিবা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পাঙ্গন একাডেমি নৃত্য বিভাগ এবং প্রিয়া ড্যান্স একাডেমি। এখানে অতিথি শিল্পী হিসেবে অংশ নেন প্রিয়া ডায়েস। কবিতা আবৃত্তি করেন মৌসুমী বড়ুয়া ও মোহাম্মদ শানু। কৌতুক পরিবেশন করেন আহমেদ নাসিম। বাংলাদেশের প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে একটি পরিবেশনা উপস্থাপন করেন কিশোর, তরুণ ও পরিণত বয়সের এক ঝাঁক শিল্পী। পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন সোনিয়া হক এবং শব্দ ব্যবস্থাপনায় মাহবুব রশীদ। এরপর ছিল শিল্পাঙ্গনের শিল্পীদের পরিবেশনায় বিশেষ কবিতার আসর ‘হে রুদ্র বৈশাখ’। আমন্ত্রিত আবৃত্তি শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শরফুজ্জামান মুকুল, শিরীন বকুল, গোপন সাহা ও মঞ্জুর কাদের। শিল্পাঙ্গনের পরিবেশনায় কবিতা ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’-এ অংশ নেন নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ শানু, মৌসুমী বড়ুয়া ও দীপ্তি বড়ুয়া। কবিতার পর্ব সঞ্চালনা করেন নাদিরা আহমেদ।

তারকা শিল্পীদের উপস্থাপনা উপভোগ করেন হলভর্তি দর্শক

শিল্পাঙ্গনের সংগীত পরিবেশনা দুটি পর্বে উপস্থাপিত হয়। প্রথম পর্ব ‘বোশেখের রং’এ-একক, দ্বৈত ও ত্রয়ী গান পরিবেশন করেন সাইফুল্লাহ পারভেজ, বিদিশা দেওয়ানজী, দীপ্তি বড়ুয়া, মৌসুমী বড়ুয়া, ফারজানা সুলতানা, শাহপার ইসলাম, মাহনাজ হাসান, মোহাম্মদ শানু, নাজিদা সায়েদ, ইশরাত কুমু, তাসফিয়া রুবাইয়াৎ ও সায়েম শাহরিয়ার। নজরুল ইসলামের গ্রন্থনায় পর্বটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী শিরীন বকুল। দ্বিতীয় পর্ব ‘এসো হে নতুন’-এ বাংলা নববর্ষ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর একক ও দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন বিদিশা দেওয়ানজী, দীপ্তি বড়ুয়া, মৌসুমী বড়ুয়া, ফারজানা সুলতানা, শাহপার ইসলাম, মাহনাজ হাসান, মোহাম্মদ শানু, ইশরাত কুমু, তাসফিয়া রুবাইয়াৎ, সামিনা আশরাফ, ইশরাত আহমেদ, সোনিয়া হক, সোনিয়া পান্না, সায়েম শাহরিয়ার, মাহমুদ চৌধুরী, আরিবাহ আহমেদ, নুসায়বা কবির, সামায়রা মাহিবা, শানিল আশরাফ, রাই সরকার ও আয়ানা মাহিবা। সংগীত পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন বিদিশা দেওয়ানজী। সহযোগিতায় সৌগত সরকার। আবৃত্তিতে নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ শানু ও মৌসুমী বড়ুয়া। গ্রন্থনায় নজরুল ইসলাম। তবলায় সংগত করেন তপন মোদক, অক্টোপ্যাডে সজীব মোদক, গিটারে আকাশ আহসান ও মোহাম্মদ শানু। শিল্পাঙ্গনের ভাব সংগীতের কথা লিখেছেন নজরুল ইসলাম, সুর করেছেন বিদিশা দেওয়ানজী।
লং আইল্যান্ডের নাসাউ কাউন্টি নির্বাহী দপ্তর থেকে নববর্ষ উৎসবে পাঁচজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এঁরা হলেন—ফেরদৌস আরা, অনুপ বড়ুয়া, দুলাল ভৌমিক, শিরীন বকুল ও প্রিয়া ডায়েস। নাসাউ কাউন্টির প্রতিনিধি বিশিষ্টজনদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। পর্বটি উপস্থাপনা করেন আকতার কামাল।
শিল্পাঙ্গনের বাংলা নববর্ষ উৎসব আয়োজনে যেসব পৃষ্ঠপোষক সহযোগিতা প্রদান করেছেন তাঁদের বরণ করা হয় ফুল দিয়ে। নজরুল ইসলামের সঞ্চালনায় মঞ্চে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় পিন্টেল কফি, নিউইয়র্ক লোকাল মেডিকেল কেয়ার, ওয়েল কেয়ার ইনস্যুরেন্স, অ্যালাইড মর্টগেজ গ্রুপ, এইচএবি ব্যাংক, ইমিগ্রান্ট এল্ডার হোম কেয়ার, জেরোন ল্যাবরেটরিজ, রুবেক্স ফার্মেসি, গুলশান ফার্মেসি, ব্লু ওশান ওয়েলথ সলিউশনস, হেলথ ফার্স্ট, কাবকো ফার্মাসিউটিক্যালস, লং আইল্যান্ড সিটি কেমিস্ট, রেজাউল করিম, ইউনাইটেড নর্দার্ন মর্টগেজ ব্যাংকার্স, মাস মিউচুয়ালস এবং বিশ্ব রং।
শিল্পাঙ্গনের বাংলা নববর্ষ উৎসবে সংগীত পরিবেশন করেন দুজন প্রথিতযশা শিল্পী অনুপ বড়ুয়া ও ফেরদৌস আরা। অনুপ বড়ুয়া মূলত নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন। ফেরদৌস আরা দেশাত্মবোধক গান দিয়ে সূচনা করে বেশ কয়েকটি নজরুল সংগীত ও পুরোনো দিনের গান গেয়ে শোনান।
অনুষ্ঠান শেষে লটারি অনুষ্ঠিত হয়। বিনা মূল্যে লটারির টিকিট সংগ্রহ করে তিনটি মূল্যবান ইলেকট্রনিক পুরস্কার জিতে নেন তিনজন ভাগ্যবান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন বেবী আজিজ। আমর আশরাফের সার্বিক সমন্বয়ে, ফালাহ আহমেদ ও আকতার কামালের ব্যবস্থাপনায়, মো. নজরুল ইসলামের গ্রন্থনায় বাংলা নববর্ষ উৎসব সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
অনুষ্ঠানে পোশাক সরবরাহ করে বিশ্ব রং, শব্দ ও আলো নিয়ন্ত্রণ করেন নিবিড় খান। শিল্পাঙ্গনের উপদেষ্টা রাহাত হোসেন নাজু, আবুল কালাম আজাদ, রোজিনা কবির, মো. রফিকুল ইসলাম, রাজিবুল হক ও শাহাব আহমেদ এবং শুভাকাঙ্ক্ষী মাহবুবুর রশীদ, মো. নুরুর রহমান, ইকবাল ইসলাম ও স্বপন কবিরের অবদানের কথাও উদ্যোক্তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।