রওশন হক
রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের কিছু ওষুধে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পেয়েছে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। ভ্যালসার্টান নামক একটি ওষুধে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন উপাদান পাওয়া গেছে। গত সাত মাস ধরে ওষুধ প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে একযোগে গবেষণা করে এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে এফডিএ।
রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ ভ্যালসার্টান বাজারে পাওয়া যায়। হাতের নাগালে থাকা এ ওষুধের মধ্যেই রয়েছে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন উপাদান।
ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন উপাদানগুলোকে সাধারণভাবে কার্সিনোজেন বলা হয়। রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধে থাকা কিছু উপাদানকে কার্সিনোজেন বলছেন গবেষকেরা। এফডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্যালসার্টান ওষুধে রয়েছে নাইট্রোসোডিমিথাইলঅ্যামিন (এনডিএমএ)। ওষুধটিতে এ উপাদানের উপস্থিতি অল্প থাকলেও দীর্ঘ ব্যবহারে তা-ই হয়ে উঠতে পারে বড় শঙ্কার কারণ। উচ্চ মাত্রায় ভ্যালসার্টান চার বছর গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
সম্প্রতি এফডিএর কমিশনার স্কট গোটলিব ও এফডিএর পরিচালক জ্যানেট উডকক এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহৃত ওষুধে থাকা উপাদানের ধরন ও এর মাত্রার ওপরই নির্ভর করে, তা ক্যানসারের ঝুঁকি কতটা বাড়াবে। সাধারণভাবে এ ধরনের ঝুঁকি কম থাকলেও, যতটা থাকে তা কম আশঙ্কার নয়।
ইউএসএ টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে বাজারে থাকা এমন কিছু রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের ওষুধ বাজার থেকে তুলে নিয়েছে কিছু কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভ্যালসার্টান, লোসার্টান ও ইরবাসার্টান। এই সব ওষুধের প্রতিটিতেই রয়েছে এনডিএমএ। এর মধ্যে ভ্যালসার্টান নিয়ে বেশি শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ এতে এনডিএমএ ছাড়াও রয়েছে নাইট্রোসোডিইথাইলঅ্যামিন (এনডিইএ) নামের আরেকটি কার্সিনোজেন। তবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত আরও অনেক ওষুধ বাজারে রয়েছে, যেগুলোর ব্যবহারে এমন কোনো শঙ্কা নেই। এফডিএ কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধের পূর্ণ তালিকা দেখতে ওয়েবসাইটে যেতে বলেছেন সবাইকে।
তবে যারা ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধগুলো গ্রহণ করছেন, তাঁদের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে নতুন ব্যবস্থাপত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত আগের ওষুধই সেবন করার নির্দেশনা দিয়েছে এফডিএ। তাদের মতে, কোনো বিকল্প ছাড়া হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করে দিলে, বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
অনলাইন ফার্মেসির প্রধান নির্বাহী ডেভিড লাইট ভার্সার বলেন, কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির সময় ব্যয়বহুল উপাদানগুলো এড়িয়ে চলতে চায়। ফলে অনেক সময় এমন কিছু উপাদান বাইন্ডার বা সলভেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ ছাড়া অন্য উৎস থেকে আসা দূষণের কারণেও এমনটি হতে পারে।
অবশ্য ওষুধে পাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান এনডিইএ ও এনডিএমএ পানি, দুগ্ধজাত পণ্যসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যেও পাওয়া যায়। এই উপাদান তাই সেসব উৎস থেকেও ওষুধে মিশতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষত ওষুধ উৎপাদনের সময় ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে এ উপাদান ওষুধে প্রবেশ করতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। তাঁদের মতে, এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর উৎপাদননীতি (জিএমপি) সঠিকভাবে মেনে না চলাও একটি কারণ হতে পারে। আমেরিকার ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের দুই বড় উৎস হচ্ছে চীন ও ভারত। এ দুই দেশে এসব উপাদান উৎপাদন প্রণালীতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে সম্প্রতি। এই পরিবর্তিত উৎপাদন প্রণালীর কারণে কিছু বিশেষ রাসায়নিক উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, বা বিদ্যমান উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া করছে, যার মাধ্যমে কিছু বিশেষ সলভেন্ট তৈরি হচ্ছে। সাধারণভাবে পরীক্ষাগারে এনডিএমএর উপস্থিতি শনাক্ত দুরূহ। এ কারণে এফডিএ নতুন একটি পরীক্ষা পদ্ধতির প্রস্তাব করেছে, যার মাধ্যমে আগে থেকেই এ উপাদানের অস্তিত্ব শনাক্ত করা যাবে। সতর্কতা হিসেবে ওষুধ তৈরির উপাদান ও তৈরি করা ওষুধ দুইই ভালোভাবে পরীক্ষার কথা বলছে এফডিএ।
গত সেপ্টেম্বরেই এফডিএ চীনের ঝেজিয়াং হুয়াহাই ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে ওষুধ তৈরির উপাদান আমদানিতে সতর্কতা জারি করে। আমেরিকা জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে এমন বহু কোম্পানি চীনের এই কোম্পানি থেকেই কাঁচামাল আমদানি করে। আর এই ঝেজিয়াং কোম্পানির সরবরাহ করা কাঁচামালেই এনডিএমএর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ধরনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ভারতের হেটেরো ল্যাবস। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্যও বাজার থেকে তুলে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় জেনেরিক ওষুধ বিক্রি করে এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে মায়লান ফার্মাসিউটিক্যালস, তেভা ফার্মাসিউটিক্যালস, স্যান্ডোজ, প্রিন্সটন ফার্মাসিউটিক্যালস, সাইকেজেন ও টরেন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস উল্লেখযোগ্য।
ভালসার্টান বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ঘোষণাটি আসে গত জুলাইয়ে। এর পর এই ওষুধ ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জুনে এই ওষুধের ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে ছিল ১১ লাখ সেপ্টেম্বরে তা নেমে ৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ৩ লাখ ব্যবহারকারীও ঝুঁকিতে রয়েছে।
এফডিএ মুখপাত্র বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে এবং আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে। তবে কত মানুষের মধ্যে এর দূষণ ছড়িয়েছে, তার পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।