মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

যে কারণে তাঁরা সরে দাঁড়ালেন

ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নের লড়াইয়ে এখন সবার সামনে রয়েছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: রয়টার্স
ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নের লড়াইয়ে এখন সবার সামনে রয়েছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: রয়টার্স

আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন অনেকেই। এক ডেমোক্রেটিক দল থেকেই প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন ২০ জনের বেশি। এখন এ লড়াইয়ে আক্ষরিক অর্থেই টিকে আছেন দুজন—জো বাইডেন ও বার্নি স্যান্ডার্স। তুলসি গ্যাবার্ড এখনো প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলেও সমীকরণে তিনি নেই।

ডেমোক্রেটিক বাছাই পর্বের শুরুতে লড়াইটা অনেককে অবাক করে দিয়েই লড়াইটা হচ্ছিল বার্নি স্যান্ডার্স ও পিট বুটিজেজের মধ্যে। আইওয়া প্রাইমারিতে স্যান্ডার্সকে ধরাশায়ীও করেছিলেন ইন্ডিয়ানার সাউথ বেন্ডের এ সাবেক মেয়র। সব মিলিয়ে স্যান্ডার্সের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক দলের প্রথাসিদ্ধ ধারার লড়াকু প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জো বাইডেন ও মাইকেল ব্লুমবার্গকে পিছে ফেলে বুটিজেজই এগিয়ে ছিলেন। সেই বুটিজেজ সাউথ ক্যারোলাইনা প্রাইমারিতে নিজের পারফরম্যান্সে হতাশ হয়ে সরে দাঁড়ান তিনি। ৩৮ বছর বয়সী সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা ১ মার্চ সুপার টিউসডের একদিন আগে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ান এবং পরদিন তিনি আরেক প্রার্থী জো বাইডেনকে সমর্থন জানান। সুপার টিউসডেতে স্যান্ডার্সের কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় এটি বড় ধরনের প্রভাব রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

স্বঘোষিত সমকামী পিট বুটিজেজ মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত হলেও স্যান্ডার্সের অনুরাগী হিসেবে নিজেকে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সমর্থনটি গেছে জো বাইডেনের দিকে। এত অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। সে যাই হোক, বুটিজেজ মূলত অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেননি। তাই টানা তিনটি প্রাইমারিতে ডেমোক্রেটিক মধ্যপন্থী হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও নেভাদা ও সাউথ ক্যারোলাইনার ফল তাঁকে ভীষণ হতাশ করে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি হওয়া সাউথ ক্যারোলাইনা প্রাইমারির ফল প্রকাশের পরদিনই তাই তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ান। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণায় বুটিজেজ স্পষ্ট বলেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করা ও নিজেদের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতেই বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন। এর অর্থ হচ্ছে, মধ্যপন্থী ভোট যেন বিভাজিত না হয়, তাই তাঁর কাছে মূল বিবেচ্য হিসেবে হাজির হয়েছে।

বার্নি স্যান্ডার্স যেন মনোনয়ন না পান, তা নিশ্চিত করাই এখন মধ্যপন্থীদের একমাত্র লক্ষ্য। ছবি: রয়টার্স

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পিট বুটিজেজের এই সরে দাঁড়ানো মধ্যপন্থী অন্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। এরই ফল হিসেবে অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে না পারা এবং এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অর্জন ধরা না দেওয়া প্রার্থী অ্যামি ক্লোবুচারও সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। সুপার টিউসডের আগের দিন ২ মার্চ তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনিও বাইডেনকে সমর্থন জানান। ক্লোবুচার অবশ্য পিট বুটিজেজের চেয়েও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, বাইডেনকে সমর্থন জানানো এবং তাঁর হয়ে কাজ করাটাই তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হচ্ছে। এ দুজনের সরে দাঁড়ানোর মুখ্য কারণ হচ্ছে, দলের মধ্যপন্থী ভিতটিকে রক্ষা করা। তাঁদের শঙ্কা ছিল, সুপার টিউসডের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়ের আগে যদি তাঁরা সরে না দাঁড়ান, তাহলে মধ্যপন্থী ভোট ভাগ হয়ে যাবে, যা সুবিধা দেবে শুধু স্যান্ডার্সকে। এ ভাবনা থেকেই তাঁরা নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।

এই শঙ্কার পেছনে যৌক্তিক কারণও ছিল। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিকসের সর্বশেষ পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্রেটিক প্রার্থীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভোটার সমর্থন নিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বার্নি স্যান্ডার্স। জো বাইডেন ১১ শতাংশ পয়েন্ট কম নিয়ে ছিলেন দ্বিতীয় অবস্থানে। শুরুতে জয় পাওয়া মধ্যপন্থী নেতা পিট বুটিজেজের অবস্থান ছিল ১১ শতাংশ সমর্থন নিয়ে পঞ্চম স্থানে। তাঁর চেয়ে এমনকি অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন স্যান্ডার্সপন্থী হিসেবে পরিচিত ম্যাসাচুসেটস সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন।

এরপর এল সুপার টিউসডে। ওই দিন ১৪টি অঙ্গরাজ্যে একযোগে ভোট হয়। এবং এতে মধ্যপন্থীদের হিসাবই সত্য প্রমাণিত হয়। বড় জয় পান জো বাইডেন। ব্লুমবার্গ অবশ্য এবারও থাকেন শূন্য হাতে, ঠিক যেমনটা থাকেন এলিজাবেথ ওয়ারেন। ফলে সুপার টিউসডের পরপর মাইকেল ব্লুমবার্গের পক্ষে পিট বুটিজেজকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। সুপার টিউসডের পরদিন, অর্থাৎ ৪ মার্চ নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বাইডেনকে সমর্থন জানান ব্লুমবার্গ। এতে অবধারিতভাবেই পাল্লা ভারী হয় জো বাইডেনের দিকে। ব্লুমবার্গ শুধু বাইডেনকে সমর্থন জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, একই সঙ্গে তিনি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রচারের কাজে তহবিল দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি কোনো লুকোছাপা করেননি। সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, স্যান্ডার্সের মনোনয়ন ঠেকাতে তিনি সম্ভাব্য সবকিছুই করবেন।

ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে স্যান্ডার্সই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ছবি: রয়টার্স

ব্লুমবার্গের এই ঘোষণার পর মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাইডেন ও স্যান্ডার্সের বাইরে ছিলেন শুধু এলিজাবেথ ওয়ারেন। রাজনীতিটি তিনি খুব সহজেই অনুধাবন করেন। এও বোঝেন যে, যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, মধ্যপন্থী ও বামপন্থী ধারার মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকায় ভোটার আকর্ষণের যত ক্ষমতাই তিনি ধরুন না কেন, শুধু নারী হওয়ার কারণেই তিনি পিছিয়ে পড়ছেন। এ অবস্থায় স্যান্ডার্সের অনুসারী এ প্রার্থী ৫ মার্চ সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বিরোধী ধারার ঐক্যের বিপরীতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনই সবচেয়ে বড় কৌশল হলেও এলিজাবেথ ওয়ারেন এখনো স্যান্ডার্সের প্রতি নিজের সমর্থন ঘোষণা করেননি। ৬ মার্চ পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছু জানাননি। শোনা যাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে স্যান্ডার্স ও বাইডেনের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করেছেন। উভয় পক্ষই তাঁর সমর্থন চেয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আরও কিছু সময় চান বলে জানিয়ে দিয়েছেন ওয়ারেন।

এ তো গেল শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা প্রার্থীদের কথা। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি আইওয়া প্রাইমারির ফলে হতাশ হয়ে সরে দাঁড়ান অ্যান্ড্রু ইয়াং। আইওয়ায় তিনি মাত্র ১ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। একই দিনে সরে দাঁড়ান মাইকেল বেনেট। তার পরদিন সরে দাঁড়ান ডেভাল প্যাট্রিকও। দুজনের কেউই ভোটারদের সমর্থন পাননি। উভয়েরই পাওয়া ভোটের হার ছিল মোট ভোটের শূন্য শতাংশ। দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেলেও আইওয়া প্রাইমারির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন টম স্টেয়ার। অবশেষে ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি সরে দাঁড়ান। আর প্রাইমারি শুরুর আগেই সরে দাঁড়ানোদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এরা হলেন জন ডিলেনি, কোরি বুকার, ম্যারিয়েন উলিয়ামসন, জুলিয়ান কাস্ত্রো, কামালা হ্যারিস, স্টিভ বুলক ও জো সেসটাক রয়েছেন, যাদের নাম এখনো রয়েছে ব্যালটে। আর ব্যালটে নাম তোলার আগেই সরে দাঁড়ানোর তালিকায় রয়েছেন বিল ডি ব্লাজিও, বেটো ও’রার্তে, টিম রায়ান, ওয়েইন মেসান, সেথ মোল্টন, জে ইনস্লি, মাইক গ্র্যাভেল, কার্সটেন গিলব্র্যান্ডের মতো রাজনীতিকেরা। নির্বাচনী প্রচারের প্রাথমিক ধাপেই তাঁরা বুঝে গিয়েছেন যে, নিজ ধারার অগ্রসর প্রার্থীদের সমর্থন জানানোটাই সব পক্ষের জন্য মঙ্গল হবে।

শুধু নারী হওয়ার কারণেই কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাননি বলে মনে করেন এলিজাবেথ ওয়ারেন। ছবি: রয়টার্স

মোটাদাগে ডেমোক্রেটিক দলে বহু দিন ধরে চলতে থাকা বিভক্তিটি দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়নের লড়াইয়ে এসে এ বিভাজন একেবারে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এ অবস্থায় শুরুতে অনেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও শেষে দু ধারায় বিভক্ত হয়েই তারা নির্বাচনের মাঠ বাইডেন ও স্যান্ডার্সের হাতে ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। সরে দাঁড়ানোদের অনেকে অবশ্য প্রয়োজনীয় নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহে নেমেই মাঠের অবস্থাটি বুঝতে পেরেছেন। কোরি বুকার, ব্লাজিওর মতো প্রার্থী নিজ নিজ অঞ্চলে অনেক জনপ্রিয় হলেও জাতীয় পর্যায়ে এখনো ততটা প্রভাবশালী নন। ফলে তাঁরা ব্যালটে নাম তুলবার আগেই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

একই অবস্থা বলতে হবে রিপাবলিকান দলেও। সেখানে শুরুতে অনেকেই দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ জানালেও একে একে সরে দাঁড়িয়েছেন। অবশ্য এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের বিষয়টি একটু দেরিতেই মঞ্চে আসছে। কারণ, ক্ষমতাসীন দল দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নতুন প্রার্থী দেওয়ার ঝুঁকি অবশ্য তেমন একটা নেয় না। রিপাবলিকান দলও নেবে না নিশ্চিত। দলীয় ঐক্য বজায় রাখতেই শত বিরোধ থাকলেও সবাই ট্রাম্পের পেছনেই দাঁড়াবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন প্রস্তাবের সময়ই দলের এ অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে দলীয় ঐক্য এবং দলের মধ্যে নিজ ধারার অগ্রসর প্রার্থীকে এগিয়ে দিতেই নির্বাচনী লড়াই থেকে প্রার্থীরা সরে দাঁড়ান। তবে ডেমোক্রেটিক লড়াইয়ে তুলসি গ্যাবার্ড এখনো কেনে আছেন, তা ঠিক নিশ্চিত নয়। স্যান্ডার্সের প্রতি অনুরাগ থাকলেও সম্ভবত প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়াতেই শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চান তিনি। তাঁর এ লড়াইকে সবাই অবশ্য শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখছেন।