৪ এপ্রিলের ঘটনা। টুইটার ব্যবহারকারীরা ঘুম ভেঙে দেখেন, আজ ইলন ও ইলন মাস্ক টুইটারে ট্রেন্ড করছে অর্থাৎ সবচেয়ে আলোচিত নাম। এর কারণ এটা নয় যে, ইলন মাস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি কিংবা বিশ্বখ্যাত এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা চমক হিসেবে নতুন কোনো কোম্পানি খোলার ঘোষণা দিয়েছেন। টুইটারে ওই দিন ইলন মাস্কের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হওয়ার কারণ, এদিন তিনি টুইটারের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ার কেনার কথাটি প্রকাশ করে সবাইকে চমকে দেন।
টুইটারের ৯ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে আচমকা প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী বনে যান মাস্ক। এরপরই জল্পনার শুরু, মাইক্রোব্লগিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে মাস্ক কতটা প্রভাব বিস্তার করবেন। এ ছাড়া টুইটারের নানা নীতিগত সংস্কার ও পুনর্গঠন নিয়েও তিনি প্রায় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে টুইট করে আসছিলেন। পরের সপ্তাহেই টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পান মাস্ক। কিন্তু এর পাঁচ দিন পর তিনি এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এতে করে টুইটারের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, কর্মী, বিনিয়োগকারী ও টুইটার নিয়ে আগ্রহী মানুষজন ধন্দের মধ্যে পড়ে যান। টুইটার নিয়ে ইলন মাস্কের পরিকল্পনাটা কী, বুঝছিলেন না তারা।
গতকাল সোমবার ইলন মাস্ক ও টুইটারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, টুইটার অধিগ্রহণে তাঁরা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। তারা আশা করছে, বছরের শেষ নাগাদ আনুষ্ঠানিক চুক্তি হবে এবং তার আগে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। মাস্কের শেয়ার কেনা ও এরপর থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তা ধরে এনডিটিভি একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। সেটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
গত ৩১ জানুয়ারি নীরবে টুইটারের শেয়ার কেনা শুরু করেন মাস্ক। ১৪ মার্চের মধ্যে টুইটারের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনেন। বিষয়টি তখন ইলন মাস্ক সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে জানাবেন, এটাই নিয়ম। স্পষ্ট করে বললে, টুইটারের শেয়ার কেনার বিষয়টি প্রকাশ্যে জানাবেন। কিন্তু ১০ দিনের মধ্যে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে বিষয়টি জানাতে ব্যর্থ হন তিনি অথবা জানাতে চাননি। কারণ, মাস্ক টুইটারের শেয়ার কিনছেন, এমন খবর প্রকাশিত হলে টুইটারের শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করবে। তাই শেয়ার কেনার কথা না জানিয়ে সস্তায় শেয়ার কিনছিলেন তিনি। কিন্তু এটা ভুল পদ্ধতি, এটা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা মামলা করেছিলেন।
মাস্ক যে টুইটারের শেয়ারের বড় একটি অংশ কিনছেন, সেটা তখনো গোপন। এর মধ্যেই মার্চের শেষ দিকে এসে তিনি টুইটারের সমালোচনা শুরু করেন। ২৪ মার্চ তিনি টুইট করেন, টুইটারের পক্ষপাতদুষ্ট অ্যালগরিদমের কারণে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। টুইটারের অ্যালগরিদম ওপেন সোর্স হওয়া উচিত।
পরদিন আরেকটি টুইট করেন মাস্ক। এবার শুধু টুইট নয়, টুইটারের নীতি নিয়ে টুইটারে একটি জরিপ করেন। জরিপে ইলন মাস্কের প্রশ্ন ছিল, ‘গণতন্ত্রের জন্য বাকস্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি মনে করেন টুইটার এই নীতি মেনে চলে?’ এরপর ২৬ মার্চ টুইটার ব্যবহারকারীদের আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে মাস্ক বলেন, ‘তাহলে কি নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম দরকার? আমি এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি।’ সেখানে অনেকে ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও মহাকাশ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রধান ইলন মাস্ককে কিছু পরামর্শ দেন। এর মধ্যে অনেকে তাঁকে বলেন, নতুন প্ল্যাটফর্ম না করে ইলন মাস্কের টুইটার কিনে নেওয়ার কথা ভাবা উচিত।
নীরবে টুইটারের শেয়ার কেনার কারণে মাস্ক নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তবে তিনি টুইটারের শেয়ার কিনছেন, বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরই মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোম্পানিটির জন্য ব্যবসায়িক প্রস্তাব দিয়ে টুইট করা শুরু করেন। এরপর মাস্ক টুইটারে আরও একটি জরিপ করেন। জরিপটি ছিল ব্যবহারকারী টুইট সম্পাদনা বাটন চান কি না, যাতে টুইট করার পর সেটি সম্পাদনা বা পরিমার্জন করার সুযোগ পাবেন টুইটার ব্যবহারকারীরা। মাস্কের এমন টুইটের পর টুইটারের প্রধান নির্বাহী পরাগ আগারওয়াল ব্যবহারকারীদের সাবধানে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই জরিপের ফল হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দিনের শেষ ভাগে এসে টুইটার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার জন্য ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে মাস্ক ইঙ্গিত দেন, তিনি এমন একটি চুক্তি সই করছেন, যাতে করে টুইটারের ১৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনতে পারবেন না।
এদিন সকালে টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য ইলন মাস্ককে অভিনন্দন জানান। টুইটারের প্রধান পরাগ আগারওয়াল টুইট করে জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে ইলন মাস্কের সঙ্গে টুইটারের আলোচনা চলছে। আগারওয়ালের এমন টুইটের পর অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেন যে কেন এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে টুইটারের আলোচনা চলছে, যিনি নীরবে নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী হিসেবে টুইটারের শেয়ার কিনছেন।
ওই দিন মাস্ক টুইটারের শেয়ার কেনার বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন এবং নিজেকে সক্রিয় বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচয় দেন। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারেন, এমন ইঙ্গিত দেওয়ার পরই তিনি নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে বিনিয়োগের বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।
এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে মাস্কের টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাস্ক টুইটার কর্তৃপক্ষকে জানান, তিনি পরিচালনা পর্ষদে যোগ দিচ্ছেন না। টুইটার কর্তৃপক্ষ ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত চুপ থাকে। মাস্ক মনোভাব পরিবর্তন করেন কি না, সেটা দেখার জন্য এমন অপেক্ষায় ছিলেন টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। তবে বিনিয়োগকারীরা ধরেই নেন, মাস্ক একজন পরিচালক। তাঁদের এক ওয়েবসাইটেও সপ্তাহজুড়ে মাস্ককে টুইটার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দেখা যাচ্ছিল।
তখন পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল, মাস্ক টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দিতে যাচ্ছেন। কিন্তু উল্টো মাস্ক এ সময় একাধিক টুইট করে টুইটারের সমালোচনা করেন এবং একই সঙ্গে কোম্পানিটির জন্য কিছু পরামর্শও দেন। এ দিন ইলন মাস্ক এক টুইট বার্তায় তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘টুইটার কি এখন মৃতপ্রায়?’ টুইটারকে মাস্ক পরামর্শ দেন, তাদের উচিত সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রধান কার্যালয়টিকে গৃহহীন মানুষদের আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলা, কারণ সেখানে কারও প্রয়োজন নেই! এ ছাড়া টুইটার নিয়ে সস্তা রসিকতাও করেন ইলন মাস্ক। তিনি পরামর্শ দেন, টুইটারের উচিত তাদের নাম থেকে ‘ডব্লিউ’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে দেওয়া।
এদিন ছিল রোববার। আগারওয়াল টুইটারের কর্মীদের ইলন মাস্কের টুইটারের পরিচালনা পর্ষদে যোগ না দেওয়ার বিষয়টি জানান। পরে টু্ইট করে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে ইলন মাস্ক কেন টুইটার পরিচালনা পর্ষদে যোগ দিচ্ছেন না, তা নিয়ে টুইটার প্রধান আগারওয়াল বা ইলন মাস্কের কেউই কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে মাস্ক সংশোধিত নথি দাখিল করেন। এর মাধ্যমে ইচ্ছেমতো টুইটারের শেয়ার কেনার সুযোগ পান তিনি। পরিচালনা পর্ষদে না থাকায় টুইটারের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বাধ্যও নন তিনি। অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মতো টুইটারের কোনো প্রতিষ্ঠাতার বড় অংশের শেয়ারের মালিকানা নেই। ফলে মাস্কের এমন কর্মকাণ্ডে টুইটারের কর্মীরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা আশঙ্কা করেন, টুইটারের জন্য এটা বড় এক আঘাত।
টুইট করে ইলন মাস্ক বলেন, তিনি নগদে ৪ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে টুইটারের সব শেয়ার অর্থাৎ টুইটারের মালিকানা কিনে নিতে আগ্রহী এবং টুইটারকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে চান। মাস্কের এমন প্রস্তাব অনুযায়ী, টুইটারের প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ২০ ডলারে। জানুয়ারিতে তিনি যখন কোম্পানিটির শেয়ার কেনা শুরু করেছিলেন, তার চেয়ে প্রস্তাবিত এই মূল্য ৫৪ শতাংশ বেশি।
টুইটার অধিগ্রহণ করতে ইলন মাস্কের এই প্রস্তাবের পর তাঁকে ঠেকাতে টুইটার কর্তৃপক্ষ নতুন একটি পদক্ষেপ নেয়। টুইটার পক্ষ থেকে জানানো হয়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী টুইটারের ১৫ শতাংশ শেয়ার কেনেন, তাহলে অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা মূল্যছাড়ে শেয়ার কেনার সুযোগ পাবেন। এতে করে মাস্ক কিছুটা দুর্বলই হয়ে পড়েন। সাধারণত কেউ কোনো কোম্পানি অধিগ্রহণ করে নেওয়ার চেষ্টায় এ ধরনের প্রস্তাব দিলে তা ঠেকানোর এ কৌশল ‘পয়জন পিল’ বা ‘বিষের বড়ি’ হিসেবে পরিচিত। টুইটারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, কোনো একজনের কোম্পানির সব শেয়ার কিনে নেওয়ার চেষ্টা ঠেকাতেই তারা এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
টুইটার কিনতে সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে একের পর এক টুইট করেন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘জ্যাক (টুইটার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সিইও জ্যাক ডরসি) টুইটার ছাড়ার পর টুইটারের পরিচালনা পর্ষদ যৌথভাবে কোম্পানির প্রায় শূন্য শতাংশ শেয়ারের মালিক।’ এ কারণে পর্ষদে টুইটারের আর্থিক স্বার্থের বিষয়ে শেয়ারহোল্ডারদের কথা বিবেচনা করা হয় না।
টুইটার কিনতে টেন্ডার প্রস্তাব দিয়ে ইলন মাস্ক বলেন, টুইটার কেনার জন্য ইতিমধ্যে তিনি ৪ হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছেন। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের দাখিল করা নথিতে মাস্ক বিস্তারিত জানিয়ে বলেন, এর মধ্যে মরগ্যান স্ট্যানলি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছেন তিনি। যার মধ্যে টেসলায় তাঁর শেয়ারের বিপরীতে নেওয়া ঋণও থাকবে। এ ছাড়া নিজের ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের শেয়ার বেচবেন।
গত রোববার টুইটার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ইলন মাস্কের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। আলোচনা চলে পরদিন সোমবার পর্যন্ত। ইলন মাস্ক টুইটার কেনার ব্যাপারে তহবিলের বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর পর থেকে টুইটারের পরিচালনা পর্ষদ মাস্কের প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করে। এরপরই মাস্কের সঙ্গে আলোচনায় বসে।
ইলন মাস্কের দেওয়া সর্বপ্রথম ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি শেয়ার ৫৪ দশমিক ২০ ডলার মূল্যে মাস্কের কাছে বিক্রি করতে রাজি হয় টুইটার। এর মাধ্যমে টুইটারের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে। মাস্ক জানান, তিনি টুইটারের বাকস্বাধীনতা, ওপেন সোর্স অ্যালগরিদম, স্প্যাম বাতিল ও নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেবেন। এদিকে টুইটারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে টুইটার অধিগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করা হবে।