‘যিনি জীবিত তাঁকে মৃতদের মধ্যে খোঁজ করছ কেন।’ পবিত্র বাইবেলের লুক লিখিত মঙ্গল সমাচারের ২৪ অধ্যায়ের ৫ পদের এই উক্তিটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিশ্ববাসীর জন্য একটি সত্যের দ্বার উন্মোচন করেছে। ঈশ্বরপুত্র যিশু মানুষ হলেন এবং আমাদের পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করলেন। মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য, মুক্তির জন্য, পাপের দাসত্ব থেকে বের হওয়ার জন্য যিশু মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। মৃত্যুকে জয় করে তিনি তৃতীয় দিনে পুনরুত্থিত হলেন। প্রভু যিশুর এই পুনরুত্থানকেই বলা হয় ইস্টার সানডে। সারা পৃথিবীতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ যথাযোগ্য মর্যাদায়, প্রার্থনায় ইস্টার সানডে পালন করে থাকে।
দীর্ঘ ৪০ দিন উপবাস, প্রার্থনা, দান ও বিভিন্ন সেবা কাজের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্ট বিশ্বাসীগণ নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। এই ৪০ দিনের শেষ সপ্তাহটিকে বলে হয় সবচেয়ে পুণ্য সপ্তাহ। সারা বছরের ৫২টি সপ্তাহের মধ্যে ইস্টার সানডের আগের রোববার থেকেই মূলত পুণ্য সপ্তাহ শুরু হয়। এই সময়ে মণ্ডলী আমাদের আরও বেশি প্রার্থনা, উপবাস, দান ও সেবা করার আহ্বান রাখে, যেন আমাদের বিশ্বাসের যাত্রায় আমরা অনেক বেশি পবিত্র মানুষ হতে পারি। পুনরুত্থানের আগের রোববারকে বলা হয় তালপত্র রোববার। যিশুখ্রিষ্ট যখন জেরুজালেম মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন, তখন জনতা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলেন। ‘হোশান্না’, ‘হোশান্না’ বলে তারা নিজেদের গায়ের জামাকাপড় রাস্তায় বিছিয়ে দিয়েছিলেন যেন যিশুখ্রিষ্ট তার ওপর দিয়ে পথ চলতে পারেন।
পবিত্র বাইবেলের মথি লিখিত মঙ্গল সমাচারের ২১ অধ্যায়ের ৯ পদে বলা হয়েছে, হোশান্না দায়ুদের বংশধর, প্রভুর নামে যিনি আসছেন তার গৌরব হোক। পুণ্য বৃহস্পতিবারকে বলা হয় আরেকটি পবিত্রতম দিন। এদিন যিশুখ্রিষ্ট পবিত্র খ্রিষ্টযোগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। যাজকত্ব সাক্রামেন্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়ে তিনি নিজেকে নমিত করেছেন। নতুন আদর্শ স্থাপন করেছেন। গুরু হয়ে তিনি শিষ্যদের পা ধুয়ে নেতৃত্বের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা খুবই বিরল, তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিষ্যদের নিয়ে ওই দিন শেষ ভোজ অর্থাৎ ‘লাস্ট সাপার’-এর পর যিশু শিষ্যদের নিয়ে প্রার্থনায় আর ধ্যানে যখন মগ্ন, তখনই ১২ জন শিষ্যের একজন যুদা ইস্কারিয়ৎ ৩০টি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে যিশুকে শত্রুদের হাতে তুলে দেন। তারপর শুরু হয় যিশুর বিচার। রাজা হেরোদ যখন যিশুর কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি যিশুকে পাঠিয়ে দেন রাজা পিলাতের কাছে। পিলাতও যখন যিশুর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনো অপরাধ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন একপর্যায়ে জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি যিশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর আদেশ দেন। এতে জনগণ উৎসাহিত হয়ে যিশুর কাঁধে ভীষণ ভারী ক্রুশ স্থাপন করলেন এবং তাঁকে নিয়ে চললেন কালভারির পথে ক্রুশে দেওয়ার জন্য। নির্মমভাবে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হল। ক্রুশের ওপর হাত-পা পেরেকে বিদ্ধ, মাথায় কাঁটার মুকুট এক যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। সবকিছুর পরও তিনি সেই সব মানুষকে ক্ষমা করে দিয়েছেন যারা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে। পবিত্র বাইবেলের লুক লিখিত সুসমাচারের ২৩ অধ্যায়রে ৩৪ পদ’—পিতা এদের ক্ষমা কর, কারণ এরা যে কী করছে, তারা তা জানে না।’
তখন বেলা প্রায় দুপুর। সূর্য আলো দেওয়া বন্ধ করল এবং সারা দেশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। বেলা তিনটা পর্যন্ত সেই রকমই রইল। জেরুজালেমের উপাসনালয়ের পর্দা মাঝখানে চিরে দুভাগ হয়ে গেল। যিশু চিৎকার করে বললেন, ‘পিতা তোমার হাতে আমার প্রাণ সঁপে দিলাম।’ এ কথা বলে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এসব দেখে রোমীয় শত সেনাপতি ঈশ্বরের গৌরব করে বলে উঠলেন, ‘সত্যিই তিনি নির্দোষ ছিলেন।’ যে লোকেরা সেখানে ছিল, তারা সবাই বুক চাপড়াতে চাপড়াতে সেখান থেকে ফিরে গেল। লুক ২৩ অধ্যায় ৪৪-৪৮ পদ। যিশুর ক্রুশীয় মৃত্যু, তাঁর যাতনা ভোগ কষ্ট—এসব কিছুই স্মরণ করা হয়। পুণ্য শুক্রবার যিশুর মৃত্যুর পর তার দেহটি সমাহিত করা হল। তৃতীয় দিন ভোরে অর্থাৎ রোববার দিন সেই স্ত্রীলোকেরা (যারা মৃত্যুর সময় ক্রুশের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন) তারা সুগন্ধি মসলা নিয়ে কবরের কাছে গেলেন। তারা দেখলেন, কবরের মুখ থেকে পাথরখানা সরানো। তারা ভেতরে যিশুর দেহখানা দেখতে পেলেন না। যখন তারা অবাক হয়ে বিষয়টি ভাবছিলেন, তখন বিদ্যুতের মতো ঝকঝকে কাপড় পরা দুজন তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। এতে স্ত্রী লোকেরা ভয়ে মাথা নিচু করলেন। লোক দুটি (স্বর্গদূত) তাদের বললেন, ‘যিনি জীবিত তাঁকে মৃতদের মাঝে খোঁজ করছ কেন। তিনি এখানে নেই, তিনি জীবিত হয়ে উঠেছেন।’
স্ত্রী লোকেরা তখন ফিরে গিয়ে শিষ্যদের কথাটা জানালেন। (বাইবেল মথি: ২৮ অধ্যায়ের ১ থেকে ৮ পদ)
মৃত্যুর পর যিশুখ্রিষ্ট ৪০ দিন এই জগতে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষকে দেখা দিয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন বাণী প্রচারের। ৪০ দিন পর তিনি স্বর্গে আরোহণ করেছেন। ঈশ্বর মানুষ হলেন, মানববেশে মৃত্যু বরণ করলেন এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হয়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন পিতার কাছে। মনুষ্যত্ব আর ঈশ্বরত্বের এই সংযোগ স্থাপন মূলত প্রমাণ করে, আমরা একদিন তাঁর সঙ্গে মিলিত হব। সেই বিশ্বাস আর সেই আশাই আমাদের ধর্মের পথে, নৈতিক জীবনের পথে চলতে সহায়তা করে। প্রভু যিশুর পুনরুত্থান আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে আনন্দ, ভালোবাসা আর শান্তি।