নিউইয়র্কে মুসলিম কমিউনিটির সেবায় টহল পুলিশের সঙ্গে নতুন একটি স্বেচ্ছাসেবক দল কাজ করবে। শিগগিরই টহল পুলিশের সঙ্গে তাঁদের মাঠে দেখা যাবে। প্রাথমিকভাবে ৩০ জনের মুসলিম সদস্য এই স্বেচ্ছাসেবক দলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও মুসলিম সদস্যকে এই দলে নিয়োগে দেওয়া হবে।
ইতিমধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন ডাউন টাউন ব্রুকলিনের বাসিন্দা মাঈন আলী। তিনি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানদের সেবায় নিয়োজিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ৩৮ বছর বয়সী আলী ১৯৯০ সালে ইয়েমেন থেকে আমেরিকায় আসেন। গত বছর ‘পানিশ এ মুসলিম ডে’-তে তিনি নিজে চার সন্তান নিয়ে খুব আশঙ্কায় ছিলেন। খুব কাছে থেকে তিনি মুসলিমদের আতঙ্কিত মুখ দেখেছেন। এখন এমন কাজে যোগ দিতে পেরে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করছেন।
লন্ডনে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর প্রচারণা চলাকালে নিউইয়র্কসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে পুলিশকে নির্দিষ্ট দিনে মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্রগুলোর আশপাশে পাহারা দিতে হয়েছিল। তারপর থেকে নিউইয়র্ক পুলিশ প্রশাসন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নিয়মিত পুলিশ টহল বাড়ানোর দিকে নজর দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় পেট্রল পুলিশের মুসলিম কমিউনিটির সেবায় নিজ ধর্মের লোককে নিয়োগ দিতে দেখা যায়।
‘হেট ক্রাইম’ বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ শুরু হলে লন্ডনের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা এক ধরনের বিশেষ চিঠি পেয়েছিলেন। তাতে গত বছর ৩ এপ্রিল দেশজুড়ে ‘পানিশ এ মুসলিম ডে’ পালন করার কথা উল্লেখ করে মুসলমানদের ওপর হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি মসজিদেও হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম দেখলেই অপমান করতে হবে, মহিলাদের হিজাব খুলে দিয়ে মারধর, অ্যাসিড-হামলাও চালাতে হবে বলে উল্লেখ করা ছিল। নিউইয়র্ক পুলিশ প্রধান মনে করছেন, সারা পৃথিবীতেই মুসলিমদের বসবাস ও নিরাপদ জীবনযাপনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
কমিউনিটির সেবার বিষয়ে মাইন আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।’ তিনি পুলিশের স্কোয়াড কারের মতো দেখতে লাল ও সাদা জরুরি আলোর বাতি দিয়ে সজ্জিত একটি সাদা ফোর্ড ট্যুরাস (Ford Taurus) গাড়ি নিয়ে কাজ করেন।
আলি স্বেচ্ছাসেবক মুসলিম কমিউনিটি পেট্রল ও সার্ভিসেসের প্রথম ৩০ জন সদস্যের একজন। তিনি ব্রুকলিনের আশপাশের এলাকায় কাজ করবেন। ধাপে ধাপে এই সেবা নিউইয়র্কের সব জায়গায় সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে নগরজুড়ে কমিউনিটি সেবা চালু করা হবে। সম্প্রতি পুলিশ বিভাগের ৭২তম প্রিসিক্টের অফ ডিউটি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যর এই দলটির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই গ্রুপের আরেক সদস্য ৩১ বছর বয়সী নূর রাবাহ বলেন, তাদের দল ঘড়ির কাটার মতো করে কাজ করবে। নূর রাবাহ সানসেট পার্কে বসবাস করেন।
মুসলিম টহল পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নাগরিকদের ভাষার অনুবাদ করে সহায়তা করবে। এই বাহিনীর সদস্যরা সাতটি ভাষায় কথা বলতে পারবে। যেকোনো ভাষায় সাংস্কৃতিক, সামাজিক ব্যাখ্যা, সন্দেহজনক কার্যকলাপের প্রতিবেদন, ট্রাফিক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া, এমনকি কিছু হারানো গেলেও তার অনুসন্ধানে তারা সহায়তা করবে। ব্রুকলিনের বোরো প্রেসিডেন্ট এরিক এল অ্যাডামস ও সহকারী চিফ ব্রায়ান জে করনি বলেন, মুসলিমদের সহযোগিতায় এই নতুন কমিউনিটি টহল পুলিশ গঠন করা হয়েছে।
এরিক ও ব্রায়ান মনে করেন, নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর মুসলিম বিদ্বেষ বেড়ে গেছে। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নাগরিকদের সম্পর্ক ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের চেয়েও বেশি মজবুত হবে। এই গ্রুপটির সদস্যরা নেভি নীল ইউনিফর্ম পরে শিফটভিত্তিক কাজ করবে। ব্রুকলিনের তিনটি ইসলামি স্কুলের শুরু এবং ছুটির সময় ছাড়াও বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। বেশির ভাগ মসজিদ, বাস ও সাবওয়ের কাছাকাছি তারা অবস্থান করবে। তা ছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা রয়েছে এমন এলাকায় তারা দায়িত্ব পালন করবে। এই সেবার বিস্তারিত বিষয় এবং কাউন্সেলিং সেবা লিংক করে অনলাইনে দেওয়া হবে।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্টের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিচিত করার জন্য মুসলিম কমিউনিটি পেট্রল সদস্যদের সঙ্গে একটি সৌজন্য সভার আয়োজন করা হয়। পুলিশ বিভাগের মুখপাত্র বলেন, যদি কিছু সন্দেহজনক মনে হয়, তাহলে ৯১১-এ কল করুন।
রোল আউটের আগে সদস্যরা তাদের মিশন ব্যাখ্যা করতে এবং বাসিন্দাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে, তার উত্তর দিতে কমিউনিটি বোর্ড সভায় অংশ নেবে। ৮ জানুয়ারি নিউইয়র্কের প্রভাবশালী আরব আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সঙ্গে এই গ্রুপটি সাক্ষাৎ করে। দুপক্ষের মধ্যে এই সেবা নিয়ে কথা হয়।
সহকারী চিফ কনোয়্যার এক সাক্ষাত্কারে বলেন, তারা এনওয়াইপিডির জন্য চোখ ও কান হিসাবে কাজ করে। কখনো কমিউনিটি টহল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে, কিন্তু তারা পুলিশ বিভাগ দ্বারা অনুমোদিত বা নিয়ন্ত্রিত নয়। নিরাপত্তা দেওয়া তাদের যৌথ দায়িত্ব, তাই একসঙ্গে কাজ করার জন্য এটি একটি সুযোগ।
সম্প্রতি আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মূলত মুসলিমদের এ দেশে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। এতে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনজাহ প্রকল্পের এক ফিউনারেল কর্মকর্তা বলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের সেবায় কাজ করার তাঁর ও অন্যদের দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন ছিল। ২০১৬ সালে একজন সিরীয় ইমামকে হত্যা ও কুইন্সে তার সহকারীকে হত্যাসহ ম্যানহাটনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা একজন মুসলমান মহিলার ওপর অগ্নিসংযোগের মতো সহিংস ঘটনার কারণে কমিউনিটি পুলিশের প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
নিউইয়র্ক নগরে আনুমানিক ৭ লাখ ৬৯ হাজার মুসলমানের বাড়ি। জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ মুসলিম। আমেরিকায় বসবাসকারী সব মুসলমানের ২২ শতাংশই নিউইয়র্কে বসবাস করে।
পুলিশ বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে ১৪টি মুসলিমদের ওপর বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনা ঘটেছিল। গত বছরের প্রথম তিন চতুর্থাংশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরও ১৪টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছিল।
কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনসের নিউইয়র্ক শাখার নির্বাহী পরিচালক আফফ নাসের বলেন, বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। বিদ্বেষপ্রসূত আক্রমণগুলো প্রায়শই চোখে পড়ে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও আক্রমণের বিরুদ্ধে এখানকার মানুষের কাছ থেকে আমরা অনেক ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এমন উদ্যোগ যা অর্থপূর্ণ ও সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
মুসলিম পুলিশ নিয়োগকে সাধুবাদ জানিয়ে নাসের বলেন, সাধারণভাবে মুসলমানদের জাগরণ হয়েছে, আমরা আমেরিকার মুসলিমরা আবার কীভাবে নিজেদের পূর্ব অবস্থান ফিরে পেতে পারি, সে ব্যাপারে সচেতনভাবে সবাইকে চিন্তা করতে হবে।