আগুনে পুড়িয়ে বইকে বিনাশ করা যায় না। মানুষ মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু বইয়ের কোনো মৃত্যু নেই। কোনো মানুষ বা কোনো শক্তি স্মৃতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে না...আমরা জানি এই যুদ্ধে বই হলো হাতিয়ার। বই সম্পর্কে আমেরিকার ৩২ তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের এই বাণী দিয়ে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত একটি বই নিয়ে আলোচনা করছি। এটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে একটি অতি মূল্যবান প্রকাশনা, যা আজ দুর্লভ বই। আমেরিকার কোনো কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে বইটি আছে।
BIRTH OF A NATION: The story of how E. Pakistan turned in to BANGLADESH বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি, কলকাতার পক্ষে ইন্দু গঙ্গোপাধ্যায় এবং রণজিৎ দাশ গুপ্ত। প্রকাশ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে। ছাপানো হয়েছে পাঁচ হাজার কপি। পেপারব্যাকে মুদ্রিত বইটির মূল্য ধরা হয়েছিল ২ টাকা। প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশর মানচিত্র যার রং দেওয়া হয়েছে নীল এবং মাঝে সাদার রং দিয়ে বাংলায় চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন ছোট ছোট এলাকার নাম। ৫৫ পৃষ্ঠার বইটি যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস।
তখনো আমাদের মুক্তিসংগ্রাম শেষ হয়নি। তাই বইটির ভূমিকার প্রথম লাইনটি লেখা হয়েছে এভাবে—
‘এটি হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য একদল সাহসী মানুষের সংগ্রামের গল্প...।’ আর শেষ লাইনটি হলো ‘...এর শেষ অধ্যায় এখনো লেখা বাকি। এর সমাপ্তি কি সুখের হবে, নাকি দুঃখের তা অনেকটাই নির্ভর করছে বিশ্ব সমাজ কী ভূমিকা পালন করে তার ওপর। যদি বিশ্ব বিবেক মৃত না হয়–আমরা বিশ্বাস করি এখনো তা হয়নি, সুতরাং আমরা আশা করি পূর্ব পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের মানুষ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে।’
বইটির প্রথমেই সংযোজন করা হয়েছে ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেডিওতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার অংশ বিশেষ। এরপরই সংযোজন করা হয়েছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটি ছবি। এরপরের দুই পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে আরও কয়েকটি ছবি, যাতে আছে যুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে বক্তৃতার ছবি, পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদের ছবি, আছে গণহত্যার ছবি, আছে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের ছবি। এরপর সংযোজন করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র। বইটির প্রথম চ্যাপটারের শিরোনাম ‘এ নিউ রিপাবলিক ইজ বর্ন’ (একটি নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্ম), যেখানে স্থান পেয়েছে কুষ্টিয়ার মুজিব নগরের আম বাগানে পাঠকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্র যা পাঠ করেছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
‘....আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং এতদ্দ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ...’
ঘোষণাপত্রটি যখন পাঠ করা হয়, নেপথ্যে তখন পতপত করে উড়ছিল গাঢ় সবুজের মাঝে লাল সূর্য যার মাঝে বাংলাদেশর মানচিত্র আঁকা নতুন প্রজাতন্ত্রের পতাকা। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করার আগে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করা হয়, গাওয়া হয় রবি ঠাকুরের গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’।
সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অনেক বিদেশি সংবাদপত্র এবং রেডির-টিভির সংবাদিকেরা। সংযুক্ত করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ। এই অংশে আরও বলা হয়েছে, সেই সময়ে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদ শহরে এবং বেলুচিস্তানে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পটি (ন্যাপ) মিছিল বের করেছিল এবং বিবৃতি দিয়ে গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছিল তারা। এ ছাড়া সিন্ধু প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বেলুচিস্তানের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন যে বিবৃতি দিয়েছিল তারও উল্লেখ আছে।
চ্যাপটার দুই থেকে পাঁচ পর্যন্ত আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। চ্যাপটার ছয়ে আছে গণহত্যার বিবরণ যা সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ ও ২৬ মার্চ যে সব বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশে ছিলেন এবং তারা বিদেশের সংবাদপত্রগুলোতে যে সব সংবাদ পাঠিয়েছিলেন, সে সব সংবাদ ক্লিপ থেকে। এদের মধ্যে আছেন আমেরিকার নিউজ উইক পত্রিকার সাংবাদিক লোরেন জেনকিন্স যিনি ১২ এপ্রিল নিউজ উইক সংখ্যায় ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর হামলার বিবরণ দিয়ে যে প্রতিবেদন ছাপেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ইউএসএ টাইম পত্রিকার প্রতিবেদক ডন কোগিনের একটি সংবাদ ভাষ্যের সংক্ষেপ যা প্রকাশিত হয়েছে ৫ এপ্রিল সংখ্যায়। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান–এর ৫ এপ্রিল সংখ্যায় ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ নাগরিকদের চোখে দেখা পাকিস্তান আর্মির নিষ্ঠুরতার যে বিবরণ ছেপেছিল তার কিছু অংশের বর্ণনা।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি এখানে ‘‘স্বাভাবিক অবস্থা” ফিরে এসেছে—এ-কথা বলার জন্য আটজন পাকিস্তানি সাংবাদিকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে সাতজন পাকিস্তান সরকারের চাহিদা অনুসারে রিপোর্ট দিলেও একজন তার ব্যতিক্রম ঘটান। তিনি হলেন অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাস, যিনি ভারতের গোয়ায় জন্ম নেওয়া একজন খ্রিষ্টান এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি দৈনিক মর্নিং নিউজের একজন সহকারী সম্পাদক এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা। সরকারি নিয়ন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণের পর জুন মাসের ১২ তারিখ তিনি সপরিবারে পাকিস্তান ত্যাগ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি বাহিনী যে পৈশাচিক অত্যাচার চালাচ্ছে, তা কোনোভাবেই পাকিস্তান থেকে প্রকাশ সম্ভব নয়। এরপরই সানডে টাইমস পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানের পৈশাচিক ও বর্বর ঘটনার সম্পর্কে তিন পাতার প্রতিবেদন ছাপেন যা সারা বিশ্ব সমাজকে নাড়া দেয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাকে অনেক হুমকির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। এই প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। এরপরের অনুচ্ছেদগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে চলছে, তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এবং বইটির শেষ অনুচ্ছেদে পাকিস্তানিদের বর্বরতার ফলে কি ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সর্বশেষ পরিচ্ছদে যুক্ত করা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে ১৯৭১ সালে বইটি ছাপার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার ক্রমপঞ্জি।
এ ধরনের বই বা প্রকাশনা হয়তো আরও আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে। আশা করি, অনেক দেরি হওয়ার আগেই আমাদের দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তো এসব বই সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।
লেখক: গল্পকার ও কুইন্স লাইব্রেরির হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেল: myshathi@gmail.com