মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ফার্মিংটন বিশ্ববিদ্যায় বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি তদন্তে ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এটি বন্ধ করে দেয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এদের বেশির ভাগই চীন ও ভারত থেকে এসেছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীরা যে একটি ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালিকাভুক্ত ছিল, সে ব্যাপারে তারা শতভাগ নিশ্চিত। অবশ্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া কেউ কেউ দাবি করছেন, তারা দালাল ও সরকার—উভয়ই পক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার।
গত ৩১ জানুয়ারি ফার্মিংটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে শিক্ষার্থীদের সব ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়। ওয়েবসাইটটির হোমপেজে পরিবর্তন করা হয়েছে, যাতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোর পাশে আইন প্রয়োগকারী ব্যাজের একটি সতর্কতা বাণী। তাতে লেখা ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ ফার্মিংটন বিশ্বিবদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।’ সরকারি কৌসুলিরা দাবি করছেন, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সবাই এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে অবগত ছিল।
উদ্ভাবনী পাঠ্যক্রম, সুবিধামতো ক্লাসের সময়সূচি এবং ভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সুবিধা দেওয়ার সুযোগ রেখে ফার্মিংটন হিলসের ফার্মিংটন বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেট বিজনেস অ্যান্ড স্টেম ইনস্টিটিউশন’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। এতে কোনো পাঠ্যক্রম, ক্লাস ও কোনো প্রকৃত ছাত্র নেই বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত সাপেক্ষে ফেডারেল প্রসিকিউটররা মামলার অভিযোগ ঘোষণার পর ইমিগ্রেশন বিভাগ জালিয়াতি ধরতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিভাগের সহায়তায় ডেট্রয়েটের উপকূলে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপন অভিযান চালায়। কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘পে টু স্টে’ পরিকল্পনা বলেছেন, যেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীরা জেনেশুনে ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জালিয়াতি করে নিজেদের ছাত্র ভিসার স্থিতি বজায় রেখে আমেরিকায় থাকতে চেয়েছেন। অন্তত ৬০০ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেছেন। সরকারি কৌসুলিরা দাবি করেন, কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং ২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বেশি মুনাফা করেছেন।
এই মামলায় কাজ করা অভিবাসন আইনজীবীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা তালিকাভুক্ত ছিলেন, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট তাদেরও আটক করেছে। ইমিগ্রেশন বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে প্রায় ১৩০ জনকে প্রশাসনিক বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটলান্টাভিত্তিক ইমিগ্রেশন আইনজীবী রবি মান্নাম বলেন, তিনি জর্জিয়া, লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা থেকে টেলিফোন পেয়েছেন। ফেঁসে যাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ মূলত ভারত ও চীন থেকে এসেছে।
মিশিগান অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি ম্যাথিউ শেনইডার বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, বিদেশি শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের জন্য মূল্যবান সম্পদ হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিকল্পিত আন্তর্জাতিক স্টুডেন্ট ভিসা প্রোগ্রামটির অপব্যবহার করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নথিভুক্ত শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ও কীভাবে কর্তৃপক্ষ সংগৃহীত টিউশন ফি ব্যবহার করবেন—সে বিষয়ে মুখ খুলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে অভিবাসন বিভাগ।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তদন্ত দলের ছদ্মবেশি এজেন্টরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ফার্মিংটন ইউনিভার্সিটির মালিক ও কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রোগ্রামের বিবরণ, টিউশন ফি ও যোগাযোগের তথ্যসহ একটি ওয়েবসাইট ছিল। কিন্তু অভিযোগপত্র অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক ছিল না ও প্রকৃত শ্রেণিকক্ষ ছিল না।
বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে টিউশন ফি দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকে জানতেন, তারা প্রকৃত কোনো ক্লাসে যোগ দেবেন না। শিক্ষার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কোনো ক্ষেত্রে তারা ডিগ্রি পাবেন না বা নেবেন না। এমনকি শিক্ষার্থীদের জানানো হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ইমিগ্রেশন আইনজীবী রবি মান্নাম গোপন অভিযানের সমালোচনা করে বলেন, কিছু ছাত্র বিশ্বাস করেছিল, তারা বৈধ প্রোগ্রামে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু শিক্ষার্থী অন্য কোথাও নথিভুক্ত হওয়ার জন্য ভারত থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন। কেবল তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোগ্রামের কারণে সেসব শিক্ষার্থী এখন প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে। তিনি বলেন, তাঁরা ফার্মিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে, তারা তাদের আগের ক্রেডিটগুলো নতুন প্রোগ্রামে যোগ করাতে পারবেন যা তাদের কাজের অভিজ্ঞতাকে জোরদার করতে পারে। কিন্তু কৌশলগত আন্ডারকভার অভিযানে আজ তারা বিপাকে। অনেক শিক্ষার্থীই আমেরিকায় বৈধ মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করেছিল। তারা বিশেষ কর্মী ভিসার অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
মান্নাম বলেন, সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য খুবই প্রশ্নবোধক ও ঝামেলাপূর্ণ একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।
হিউস্টনের অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী রাহুল রেড্ডি বলেন, তিনি ফার্মিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে নথিভুক্ত প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অন্যরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অবশ্যই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত যাতে নিয়মিত ক্লাস হয় না বা অবিলম্বে ওয়ার্ক পারমিট দেয় না।
মিশিগানের এ ঘটনা দুই বছর আগে নিউজার্সিতে ঘটে যাওয়া একই ধরনের একটি ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারি কোসুলি ও আইস কর্মকর্তরা বলেছেন, অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ও ল্যাটিন শব্দের ‘হিউম্যানস, সায়েন্টিয়া, ইন্টিগ্রেটাস, সংবলিত সিল দিয়ে সেট আপ করা নর্দার্ন নিউজার্সি বিশ্ববিদ্যালয়টিও ভুয়া ছিল। সে সময় কর্তৃপক্ষ ২০ জন দালালকে গ্রেপ্তার করেছিল যারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছিল। ২৫ জন বেনামি শিক্ষার্থীকেও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। কয়েক দিনের মধ্যে ১ হাজার শিক্ষার্থীকে অভিবাসন আদালতে হাজির করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যারা বিতাড়নসহ আমেরিকার নাগরিকত্ব হারানোর মতো ঝুঁকিতে পড়েছিল।
ফার্মিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে তালিকাভুক্ত হওয়ার ফলে কে বা কারা লাভবান হলেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ তা খতিয়ে দেখছে। তবে অসংখ্য বিদেশি শিক্ষার্থীর অভিবাসন স্ট্যাটাস ও জীবন যে অনিশ্চিত অবস্থার হুমকির মুখে পড়েছে, তা বলা বাহুল্য।