মিট মাই মনভোলা ডেনিয়েল

নিজের বাসায় পাখির খাঁচার সামনে লেখিকা
নিজের বাসায় পাখির খাঁচার সামনে লেখিকা

প্রায় একই রকম দেখতে নীল পাখিগুলোর সংখ্যা যখন ৭/৮ টির মতো, তখনো আমি ডেনিয়েলকে ঠিক ঠিক চিনতে পারতাম। কারণ ও ছিল একটু নাদুসনুদুস, আর সব সময় বকের মতো সাদা রঙের বিয়াঙ্কার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকত। দুর্লভ লাল চোখের বিয়াঙ্কাকে সে ভালোবেসেছিল এবং দুজনে সুন্দর সংসারও পেতেছিল একসময়। বিয়াঙ্কা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর (সেটি অন্য একটি কষ্টের গল্প) এবং নীল পাখির সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি ছাড়িয়ে গেলে আমি আর ডেনিয়েলকে চিনতে পারতাম না, খুঁজে পেতাম না, বুঝতাম না আসলে ঠিক কোনটি ডেনিয়েল। চোখে চোখে তাকালে অধিকাংশ পাখি চোখ নামিয়ে নিলেও ডেনিয়েল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। বড় মায়াময় সে চাহনি। আমি সে মায়ায় জড়াতে ভয় পেতাম, এখনো পাই, তবুও মুখোমুখি তো হতেই হয় প্রতিদিন। পুরোপুরি নির্লিপ্ত হতে পারলে তো মুক্তিই পেয়ে যেতাম। জানি, সে মুক্তি আমার মতো আবেগপ্রবণ মানুষের জন্য অনেক দূরের এক কঠিন পথ।
যাকগে, নীল ডেনিয়েলের প্রতি আমার অন্যরকম একটি দুর্বলতা ও ভালোবাসা ছিল শুরু থেকেই। প্রথমত সে আমার পোষা প্রথম নয়টি পাখির একটি আর দ্বিতীয়টি বিয়াঙ্কার হঠাৎ মৃত্যু। সেই প্রথম আমার জীবনে কোনো পাখির মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখা। সেটি একই সঙ্গে কষ্ট, মৃত্যুর আশ্চর্য সৌন্দর্য এবং অদ্ভুত এক উপলব্ধি ও বিস্ময়ের গল্প। আর তৃতীয়টি পাখিটির মনভুলো স্বভাব। সব ভুলে যেতো। এমনিতেই পাখিদের স্মরণশক্তি কম, তার ওপর ডেনিয়েলের স্মরণশক্তি আমার অন্য পাখিদের তুলনায় আরও কম। অন্য কোনো পাখি সহজে না ভুললেও বেচারা ডেনিয়েল প্রায়ই ভুলে যেতো ওর ভালোবাসার বিয়াঙ্কা কোন নেস্টিং বক্সে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। সে জন্য মারও কম খায়নি অন্য পুরুষ পাখিদের কাছে। বিশেষ করে ভোরের দিকে প্রায়ই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ভুল নেস্ট বক্সের দরজার সামনে। আর যায় কোথায়? মার খেলেও পাল্টা মারতে যায়নি কখনো কাউকে, আমি দেখিনি। নিজের ভুলটা স্বীকার করে চুপ ও শান্ত থাকত।
বর্তমানে নীল রঙের পাখির সংখ্যা আরও বেড়েছে। সব নীলের মধ্যে আমি তবুও খুঁজি ডেনিয়েলকে। সারা বছর অপেক্ষা করি আমেরিকায় কখন গ্রীষ্ম মৌসুম আসবে? গ্রীষ্মের অল্প কিছু সময় হলেও ডেনিয়েলকে আমার খুঁজে বের করে দেখতেই হয়, না হলে আমার ভালো লাগে না, মন খারাপ হয়। ও যে আমার ভীষণ কষ্ট পাওয়া, বেদনায়ও নীল হওয়া এক নীল পাখি!
ডেনিয়েলকে চিনে রাখতে একবার গোলাপি রঙের নেলপলিশ আলতো মাখিয়ে দিয়েছিলাম দুপায়ে, রাগ করেছিল খুব। রাগ না হলেও পছন্দ যে একদম করেনি, সেটুকু বুঝতে পেরেছিলাম। খুশি হলে পাখিদের চোখে তাকালে সেটি বোঝা যায়। আমি এখন কিছুটা বুঝি।
তো গ্রীষ্ম না আসা পর্যন্ত ড্যানিয়েলকে চেনা খুব মুশকিল। বিশেষ করে শিম গাছ যখন প্রচুর লতাপাতা আর ডাল নিয়ে মাচায় উঠে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে, তখনই শুধু দেখা পাওয়া যাবে, চিনতে পারা যাবে আমার মনভুলো নীল ডেনিয়েলকে। কিন্তু কীভাবে? খুব সহজে।
আমাদের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড বাগানেই এভিয়ারি পাখিদের ছোট দুটি ঘর। যখনই ডেনিয়েলকে দেখতে খুব ইচ্ছে হয় আমি মাচা থেকে ঝুলে পড়া শিমের একগুচ্ছ লতা দুহাত ভরে নিশ্চিন্তে পাখি ঘরের দিকে যেতে শুরু করি, ইনফরমার পাখি (তথ্যপাখি, এরা যাবতীয় খবরাখবর দ্রুত অন্যদের জানিয়ে দেয়) যে কয়টি আছে, ঘরের ভেতরে এ–মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ওড়াউড়ি করে ‘সবুজ ট্রিট আসছে, সবুজ ট্রিট আসছে’ হয়তো এই জাতীয় কিছু ওদের নিজস্ব ভাষায় বলে মুহূর্তেই রটিয়ে দেয়! বুঝি এ জন্য যে, অধিকাংশ পাখি তখন উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত হয়ে ব্যস্ত ওড়াউড়ি, ডাকাডাকি, চেঁচামেচি, এমনকি নেস্টিং বক্সে যারা ডিম পাড়তে বা ডিমে তা দিতে ঢুকেছিল, ওরাও হন্তদন্ত হয়ে দ্রুত নেস্টিং বক্সের ফুটো দিয়ে মুখটা বের করে এদিক–সেদিক তাকাতে শুরু করে। কী হলো, কী হলো—এমন মুখভঙ্গি করে তাকিয়ে থাকে।
একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই পাখিদের এই ছোট ছোট মজার ব্যাপারগুলো বোঝা যায়। আনন্দ ও খুশি প্রকাশের জন্য যার যা করতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছেমতো সেগুলোর প্রকাশ ঘটিয়ে যার যার স্পটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন আমি দুটি দরজার প্রথমটির ছিটকিনিটা খুলব। ‘খুটুস’ করে একটা শব্দ হওয়ামাত্র সবাই লাইন ধরে একদম চুপ, স্থির ও শান্ত! কোনো নড়াচড়া নেই! কে বলে পাখিরা খুব চঞ্চল? বহুবার ওদের আমি একদম চুপ, নিঃশব্দ হয়ে বসে থাকতে দেখেছি।
প্রথমটি সেফটি ডোর, খোলার পর চারকোনা, চতুর্ভুজের মতো একটি জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আর প্রথম দরজা বন্ধ করে দ্বিতীয় দরজাটি খুললেই পাখিগুলো। ওদের মুখস্থ আমার পথ। আর সবটাই যেহেতু আয়রন নেটের, তাই দেখারও কোনো সমস্যা নেই। এমনিতে গ্রেইন, ভাত, ফ্রুটস ইত্যাদি অন্য খাবার নিয়ে গেলে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকি না, কিন্তু এত পাখির ভিড়ে নীল ডেনিয়েলকে খুঁজে পেতে শিমের লতাগুচ্ছ নিয়ে গেলে অবশ্যই ভিন্ন কথা।
হাসি হাসি মুখ করে আমি চতুর্ভুজের মতো জায়গাটায় সিম্পলি দাঁড়িয়ে থাকি, দ্বিতীয় দরজার ছিটকিনিটি ইচ্ছে করে আর খুলি না। মজা ও কৌশলের এ খেলাটুকু আমাকে খেলতেই হয় আমার মনভোলা পাখি ডেনিয়েলের জন্য।

খাঁচায় নানা প্রজাতির পাখি

আমি আসলে ভালো করে নিশ্চিত হতে চাই, ঘরের ওপরের দিকে কোনো কোনায় ডেনিয়েল এই সময়ে যদি ঘুমিয়েও থাকে, অন্য পাখিদের হঠাৎ চেঁচামেচি, ওড়াউড়ি ও কলকাকলিতে যেন ও জেগে ওঠে এবং আমাকে দেখতে পায়। পাখিটা হয়তো জানেও না, ওর নাম ডেনিয়েল, তবুও আমি কিছুক্ষণ ডেনিয়েল ডেনিয়েল বলে ডাকতে থাকি ওর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
আগেই বলেছি, দুই দরজার মাঝখানের চারকোনা জায়গাটুকু সেফটি রিজনে করা হয়েছে, যতক্ষণ না দ্বিতীয় দরজাটি খোলা হচ্ছে ততক্ষণ সেখানে পাখিরা আসতে পারে না। কিছুক্ষণ ডেনিয়েলকে ডাকাডাকির পর আমি একসময় খুলে দিই দ্বিতীয় দরজাটি আর অপেক্ষা করতে থাকি একটি চমৎকার ও ম্যাজিক মুহূর্তের জন্য! যদিও আমার চোখ সব কটি নীল রঙের পাখিদের ভিড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে ডেনিয়েলকে, তবুও আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, সব পাখিকে পেছনে ফেলে, নির্ভয়ে, একদম সবার আগে উড়ে এসে নীল রঙের যে পাখিটি আমার দুহাতে ধরা শিমের লতাগুচ্ছের ওপরে মহানন্দে বসবে, সে-ই হচ্ছে ডেনিয়েল! আমার আদরের ডেনিয়েল।
এ এক অপার্থিব অনুভূতি। একই সঙ্গে আনন্দ ও বিমুগ্ধ বেদনা মিশ্রিত। চোখের জলে আবিষ্কার করি, বুঝি এবং নিশ্চিত জানি তখন এই তো সেই ডেনিয়েল। কষ্ট পাওয়া আমার নীল পাখিটা। তারপর একবার মাত্র আমার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে, ওর গভীর কালো আর ছোট ছোট গোল গোল দুই চোখ দিয়ে, পরক্ষণেই ওর স্বভাব অনুযায়ী আমাকে পুরো অগ্রাহ্য করে যথারীতি শিমের সবুজ পাতা ও কাণ্ড ঠোকরাতে থাকবে। খেলতে থাকবে। হুবহু ওর জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা সে-ই বিয়াঙ্কার মতো।
প্রথমদিকে পাখিগুলো আমাদের বাড়ির ভেতরে বড় একটি খাঁচায় থাকত ছুটির দিনে পাখিদের আমি বিভিন্ন ট্রিট যেমন দিতাম পাশাপাশি বাগান থেকে ছেঁটে ফেলা বিভিন্ন গাছের পাতাসহ ছোট ছোট ডাল, লতা-পাতা, ফুল, ইত্যাদি দিয়ে খাঁচাটিকে সাজাতাম। দেখতেও সুন্দর লাগত আর পাখিরাও খুব খুশি হতো। কেউ ডালে বসে থাকত তো কেউ পাতার গন্ধ নিয়ে পরখ করত, আর ভেতরে ফাইবার আছে এমন কোনো গাছের ডাল-পালা হলে তো কথাই নেই! সব খেলনা/টয় বাদ দিয়ে একটাই খেলা—খুঁটে খুঁটে ডালপালার ভেতরের ফাইবার/সুতো বের করাl পাতার মধ্যে সব থেকে বেশি পছন্দ করত পেয়ারা গাছের পাতা, কয়েকজন তো পেয়ারার ডালেও ঘুমাত নিজেদের স্পট ছেড়ে দিয়ে।
কয়েক বছর আগে এমনি এক বিকেলে পেয়ারার পাতাসহ দুটি ডাল আর মাচা থেকে ঝুলে পড়া শিম গাছের কিছু প্যাঁচানো লতা নিয়ে এলাম। সেদিনই প্রথম আমি শিমের কিছু লতাগুচ্ছ ওদের খাঁচায় এনে দিই, সিম্পলি ওদের ঘর সুন্দর সবুজ দেখতে লাগবে বলে। খাবে বা শিমের সবুজ লতা এত পছন্দ করবে তখনো জানতাম না। মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম, অন্য পাখিগুলো যথারীতি তাদের প্রিয় পেয়ারা পাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বিয়াঙ্কা পাখিটি সবার আগে উড়ে গিয়ে শিমের লতাপাতার ওপর বসে খুঁটতে শুরু করেছিল, আর ড্যানিয়েলও তার অভ্যাস অনুযায়ী বিয়াঙ্কাকে অনুসরণ করে যোগ দিয়েছিল ওর সঙ্গে, পরে অন্য সব পাখির কাছে শিম–লতা ক্রমশ প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এটি সত্যি যে বিয়াঙ্কা সব সময়ই নতুন নতুন জিনিস ট্রেই করতে পছন্দ করত, সেটি ফুড, টয় বা ট্রিট যেটিই হোক না কেন, নতুন এই আবিষ্কারে আমি তো বিরাট খুশি হয়েছিলাম কারণ প্রতিবছর শিমগাছে ভরে যায় আমার দুই সবজি মাচা।
সেই থেকে শুরু হয়েছিল। তখন বড় একটি খাঁচায় আমার বিভিন্ন রঙের নয়টি পাখি থাকে। প্রতি গ্রীষ্মে নিয়ম করে বিকেলের দিকে যখন বাগানে পানি দিতাম, তখন অন্যান্য ট্রিটের সঙ্গে পাখিদের আমি শিম লতাপাতাও ট্রিট হিসেবে দিতাম, পাখিরা খুব খুশি হতো। প্রায়ই চোখে পড়ত বকের মতো সাদা রঙের বিয়াঙ্কাই প্রথম উড়ে চলে আসছে যেখানেই থাকুক আর ওর পিছু পিছু যথারীতি নীল রঙের ডেনিয়েল। ব্যাপারটি বাড়ির ভেতরে খাঁচাতে যেমন করেছে, পরে ব্যাকইয়ার্ড এভিয়ারিতেও। মজার ব্যাপার হলো, ডেনিয়েল যতটা না পছন্দ করত শিম লতাগুচ্ছ, তার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করত বিয়াঙ্কার পিছু পিছু উড়ে যাওয়া, বিয়াঙ্কার পাশে বসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা। যেখানেই সাদা রঙের বিয়াঙ্কা, সেখানেই নীল রঙের ডেনিয়েল।
পাখির সংখ্যা বেড়ে গেলে ব্যাপারটি আমি ভুলেই গেলাম প্রায়। কিন্তু বিয়াঙ্কার মৃত্যু হলে ডেনিয়েলের জন্য আমার মন হু হু করে উঠত, বিশেষত যখন পাখি ঘরে যেতাম আর বিয়াঙ্কার নেস্টিং বক্সটা দেখতাম, যেটি এখন দখল করে নিয়েছে হলুদ রঙের এক জোড়া পাখি। সুখেই দিন কাটাচ্ছে ওরা। বোঝার কোনো উপায় নেই, এই ছোট্ট কাঠের ৭x৬x৬ ইঞ্চি ঘরে একসময় বাস করত বিয়াঙ্কা, আর দরজার বাইরে সংযুক্ত ছোট্ট কাঠিতে দাঁড়িয়ে বা বসে কাটিয়েছে ডেনিয়েল কত কত মুহূর্ত। জানি, কোনো কিছুই শূন্য থাকে না, পূরণ হয়ে যায় প্রাকৃতিক নিয়মেই। তবুও দুচোখ প্রায়ই খুঁজে বেড়াতো ডেনিয়েলকে, যদি এই নেস্টিং বক্সের আশপাশে বা ওপরে কোথাও দেখা যায় এই আশায়। বিভিন্ন রঙের পাখি থাকে, ওড়াউড়ি করে অনেক নীল রঙের পাখিও, তাদের মধ্যে ঠিক কোনটি ডেনিয়েল আমি পুরোপুরি চিনতে পারতাম না।
এমনি করে বহু দিন যায়। কিন্তু পাখি ঘরে ঢুকলেই হৃদয় হু-হু করাটা আমার ক্রমশ বেড়েই চলছিল। ইচ্ছে করত, ডেনিয়েলকে খুঁজে বের করে সারাটা বিকেল শুধু কোলে নিয়ে বসে থাকব। ঘরে এনে সিঙ্কে অল্প পানি জমিয়ে গোসল করতে দেব। আরও কত কী। শুধু ভাবি, কিন্তু শান্তি পাই না। ভাবতে ভাবতে আচমকা একদিন হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল, বিয়াঙ্কার স্বভাবসুলভ সেই ব্যাপারটি মানে সবার আগে শিমের লতায় উড়ে আসার ব্যাপারটি। মনে হলো, কেউ যেন আমাকে মনে করিয়ে দিল। অন্তরাল থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ভুলে গেছ?
আর এই স্মৃতিটুকুর স্মরণই ছিল আমার মনভোলা ডেনিয়েলকে অনেক নীল পাখির ভেতর খুঁজে বের করার একমাত্র উপায় যার ওপর নির্ভর করে শুরুটা অন্তত করতে পারি। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না, বিয়াঙ্কা যেহেতু নেই আর এখন, কাকে ফলো করে পিছু পিছু আসবে ডেনিয়েল? পাখিরাও কি মানুষের মতো ভালোবাসে? মানুষের মতো ভালোবাসার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে সেদিন রাতটা পার করেছিলাম।
পরদিন ভোরেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মাচা থেকে একগাদা শিম লতাগুচ্ছ কেটে নিয়ে হাজির হয়েছিলাম পাখি ঘরে, চতুর্ভুজে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, অবাক কাণ্ড। আমার সন্দেহকে উপড়ে ফেলে, আমাকে বিস্মিত করে সেদিন সেই নীল ডেনিয়েল ঠিক ঠিক চলে এসেছিল হুবহু বিয়াঙ্কার মতো উড়ে উড়ে এবং অন্য সব পাখির আগে। সেই আগের অভ্যাস মতো। পর পর তিন দিন, হ্যাঁ একই ঘটনা—সবার আগে নীল রঙের ডেনিয়েলই আসে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার সে মাহেন্দ্রক্ষণে, আমি ছোট বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। দুচোখ ভেসে গিয়েছিল, তবুও মনে মনে উচ্চারণ করেছিলাম–হায় রে ডেনিয়েল! আমার পুউর ডেনিয়েল। এত কিছু ভুলে গেলি, কিন্তু বিয়াঙ্কা, তার প্রতি ভালোবাসার এই স্মৃতিটুকু ভুলতে পারলি না। ভুলে গেলেই তো ভালো হতো, কষ্ট কম হতো, তাই না? ডেনিয়েল মুখ তুলে শুধু একবার তাকায় আমার দিকে, ওর কালো গভীর দুটি চোখে তখন অদ্ভুত এক আলো খেলা করে, চিক চিক করে ওঠ। কত কত কথা যে সেখানে। আমি, মানুষ আমরা, কোনো দিন হয়তো তা জানব না।
সব ভুলে গেলেও সত্যিকার ভালোবাসার স্মৃতি পাখিরাও হয়তো কখনো ভোলে না, ভোলা যায় না। ভালোবাসা কখনো হারায় না, কোথাও না কোথাও ঠিক বেঁচে থেকে জ্বলতে থাকে। জ্বলতে থাকে সব সময়। আমার হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে আজ বিকেলেও। দেখা হয়েছে ডেনিয়েলের সঙ্গে। মিস্ট অপশনে রেখে পানির পাইপে গোসলও করিয়ে দিয়েছি। খুব খুশি ডেনিয়েল।
প্রকৃতি বলি বা স্রষ্টা বা পরম সত্তা, কারও প্রতি ভীষণ গভীর এক কৃতজ্ঞতাবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আজও! দুচোখ জলে অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে যাওয়ার আগেই আমি লতাগুচ্ছের ওপরে সদ্যঃস্নাত দাঁড়িয়ে থাকা ডেনিয়েলকে নিয়ে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ওদের ঘরে ঢুকি। ঘরের মাঝখানে ছাদ থেকে সিঁকে ঝোলানো একটি বড় পাত্রে লতাগুচ্ছগুলো রাখি। ডেনিয়েল উড়ে বা সরে যায় না, আগের মতোই বসে খুটোখুটি করে, খেলতে থাকে।
এরপরই উড়ে উড়ে এসে অন্য পাখিরাও একে একে পাত্রের চারপাশে লাইন ধরে জমা হতে শুরু করবে। আমি আরেকবার ডেনিয়েলকে দুচোখ ভরে দেখে নিই, দূর থেকে নিজের মতো করে আদর করি অনেক, তারপর বেরিয়ে আসি পাখি ঘর থেকে।
আরও যত দিন বেঁচে আছে ডেনিয়েল, বেঁচে আছি আমিও যত দিন, প্রতি বছর গ্রীষ্ম এলে ডেনিয়েলকে স্পষ্ট চিনতে পারব—এটুকু আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আমি কৃতজ্ঞ প্রকৃতির কাছে, ভীষণ কৃতজ্ঞ!
এ পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে ওকে চিনতে পারার এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার দুচোখ বারবার টলটলে জলে ভরে ঝাপসা হয়ে উঠবে জানি এবং এও জানি, তা কোনো কষ্ট বা দুঃখে নয়—অপার্থিব এক আনন্দ, প্রশান্তি ও সুখানুভূতিতে।