বর্তমানে শুধু নিউজিল্যান্ডে নয়, সারা বিশ্বেই জাসিন্ডা আরডার্ন এখন জনপ্রিয়। শান্তিপ্রিয় দেশ নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা অনন্য। মুসলমানদের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন, অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর যে উদার মনোভাব আর ভয়াবহ এই সংকটের সময় তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছে—তা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। জাসিন্ডা বিশ্বে প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সন্তান নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন। সন্তানকে তিনি কাছেই রেখেছিলেন। শুনেছি, তাঁর সন্তানকে তিনি বুকের দুধ পান করাতেন। বক্তব্য দেওয়ার সময় সন্তান ছিল সঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের কোলে।
জাসিন্ডা যেমন দেশের দায়িত্ব পালন করছেন, তেমনি মা হিসাবেও দায়িত্বে কোনো অবহেলা করেননি। একজন রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে কাজের অজুহাতে কিংবা ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে দূরে অন্যের তত্ত্বাবধানে রেখে কাজ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সন্তানের জন্ম দেন আরডার্ন। এ জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন তিনি। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইলে তিনি আরও বেশি ছুটি নিতে পারতেন, তা করেননি। আইনের জায়গায় বা দায়িত্বের জায়গায় তিনি অটুট বলা চলে। এসব ক্ষেত্রে জাসিন্ডাকে অন্য রাষ্ট্রনায়ক বা ব্যক্তিদের চেয়ে ব্যতিক্রম বলা চলে।
মাতৃত্বের জায়গায় পৃথিবীর সব নারী একই মনে হয়। যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন, যত শিক্ষিত হোক না কেন, যত মানবিক হোক না কেন, সন্তানের প্রতি সব মায়ের একই রকম অনুভূতি। একজন মানুষ যখন মায়ের জায়গায় আবির্ভূত হয়, তখন সে হয়ে যায় একেবারে ব্যতিক্রম। অর্থ বা ক্ষমতা থাকলেই যে ভালোবাসা বদলায় না, জাসিন্ডা তার অনন্য উদাহরণ।
শুধু জাসিন্ডা নয়, হিলারি ক্লিনটন, মিশেল ওবামা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁরাও মা হিসেবে সফল বলা চলে।
মিশেল ওবামা তো তাঁর দুই মেয়েকেই খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করিয়েছেন। গ্রীষ্মের ছুটি এলে দোকানে কাজ করতেও উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছিলেন, বাচ্চারা যেন বুঝতে পারে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন, তারা যেন অনুভব করতে পারে জীবনের বাস্তবতা। হিলারি ক্লিনটনও মা হিসাবে চেলসিকে চেষ্টা করছেন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কণ্টকময় পথে হেঁটেছেন, তাঁর জীবনে চড়াই-উতরাই কম ছিল না। এর মধ্যেও চেষ্টা করেছেন সন্তানদের মানুষ করতে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সন্তান জন্ম দেন নিউজিল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা। জাসিন্ডা ২০১৮ সালে ‘ফোর্বস’-এর প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। ছিলেন টাইম সাময়িকীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও। এত এত প্রতিভা আর অর্জনের পরও মা হিসেবে তিনি একেবারে সাধারণ! এই ‘সাধারণ মা’-ই তাঁকে আরও বেশি অসাধারণ করে তুলেছে।
১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া জাসিন্ডা মাত্র ১৭ বছর বয়সেই যুক্ত হয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টির রাজনীতিতে। নিজের প্রতিভা এবং কর্মকাণ্ড দিয়ে সেখান থেকে ধাপে ধাপে আজকের এই অবস্থানে আসেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসেও তিনি সবচেয়ে কম বয়সী সরকারপ্রধান। ব্যক্তিগত জীবনে একজন প্রাণচঞ্চল মানুষ। আসলে এরকম বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে। যেসব নারী রাজনৈতিক জীবনে সফল বা ব্যর্থ যাই হোন না কেন, মা হিসেবে অন্য সবার মতোই সাধারণ তাঁরা।
হয়তো, সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার সময় সব মাকে একই পথে হাঁটতে হয়, সে জন্য হয়তো অনুভূতিগুলো একই রকম। সব মায়ের প্রসবের বেদনা, কষ্ট একই হয়। আর এ কষ্টের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। একজন সাধারণ মাও তাঁর সর্বোচ্চ স্নেহ-মমতায় আগলে রাখে সন্তানকে।
তবে একজন দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো, তাঁকে দেশও চালাতে হয় আবার সন্তানকে দেখতে হয়, এ ক্ষেত্রে জাসিন্ডা সফল। আজ তিনি সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই প্রিয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানানোয় দুবাইয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ আলখলিফায় জাসিন্ডার ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। উচ্চতার শিখরে পৌঁছে গেছেন তিনি। তবে একজন মা হিসেবে জাসিন্ডা সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, একদিন তাঁর সন্তান বড় হয়ে যখন দেখবে তাঁর মা এত বড় বিখ্যাত একজন মানুষ হয়ে, এত বিত্তশালী মানুষ হয়েও তাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি। ভালোবেসেছে অন্য মায়েদের মতোই। ক্ষমতার দোহাই দিয়ে কিংবা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে দূরে সরে যায়নি। সে সন্তান আর যাই হোক এই মাকে কখনো অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করতে পারবে না।
সন্তান লালন-পালন আর রাষ্ট্রীয় কাজ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী ক্লার্ক নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করছেন। তাঁর সহানুভূতি, মানবিকতাই তাকে এই অবস্থানে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে জাসিন্ডা যেমন সফল, মা হিসেবেও তাই। আসলে মানুষ হিসেবে একজন মানুষ যখন মানবিক হয়, তখন সে সব ক্ষেত্রে, সব জায়গায় তাঁর সাফল্যের সাক্ষর রাখে। জাসিন্ডাও তাই।