প্রথম আমেরিকায় আসা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তারপর কম করে হলেও আরও ৩০ বার এসেছি। আসলেই এই দেশ আমাকে টানে । প্রতিবারই বিশাল এই দেশের কোন না-কোন রাজ্য ভ্রমণ করা হয়। এবার আবার পরিবারকে আমেরিকা রেখে থিতু হতে চাই। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের জরিপে ঢাকা বারবার বাসের অযোগ্য শহরের দ্বিতীয় শীর্ষ স্থান দখল করে নিচ্ছে। আমেরিকা গেলে এ নিয়ে ভাবি আর ঘুরে দেখি। দেখি তাদের শহর বন্দর। দেখি নগর কেন্দ্র, মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, একদিন আমরাও ...।
এবার আর আমার স্ত্রীকে বুঝিয়ে শুনিয়েও আর ফেরাতে পারলাম না। সন্তানদের উচ্চশিক্ষার বিষয়টিও চলে আসে। মানতেই হবে, লেখাপড়ার জন্য আমেরিকার স্থান বিশ্বে প্রথম। আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা অনেক সংঘবদ্ধ। তাদের মধ্য পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা অনেক বেশি, যা এখন আমাদের দেশে বিরল হয়ে উঠেছে। এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি থেকে একদম কাছাকাছি ২/৩ ঘণ্টার ড্রাইভেও বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে। এবার কয়েকটি পরিবার মিলে সে রকমই একটি বেড়ানোর স্পট বেছে নিই। পেনসিলভানিয়ার পকোনো ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত হলো।
পকোনোতে দুই রাতের জন্য আট বেডরুমের একটি ভিলা বুকিং করা হলো। ওয়েবসাইটে গিয়ে সুন্দর আকর্ষণীয় ভিলাটি খুঁজে বের করে বুকিং দেওয়া হয়। এসব কাজের জন্য এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জুড়ি নাই। এসব কাজ করেছিল বন্ধু জিল্লুরের ছেলে কৌশিক এবং আবদুর রবের মেয়ে সায়মা। সিদ্ধান্ত হলো, সবাই যার যার গাড়ি নিয়েই যাবেন।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই নিজের গাড়িতে জিপিএস-এ ঠিকানা বসিয়ে যার যার মতো করে রওনা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় নামার কিছুক্ষণ পরেই যে বৃষ্টি শুরু হলো, তা শেষ হলো দুই দিন পর। বেড়ানোর পুরো সময়টুকুই বলতে গেলে বৃষ্টির মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল।
দুপাশে উঁচু-নিচু পাহাড়, কখনো বা দুই পাহাড়ের মাঝের মহাসড়ক দিয়ে গাড়ি চলছিল। বৃষ্টির পানিতে ভিজে পাহাড়ের ওপর ঘন বনে আচ্ছাদিত গাছগুলোকে অনেক সবুজ দেখাচ্ছিল। এত ঘন সবুজের সমারোহ সবুজের দেশ, আমাদের দেশেও দেখা যায় না। গাড়ি কখনো বা পাহাড়ের একদম চূড়ায় উঠছে। আবার কখনো বা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেকটা সিলেটের তামাবিল থেকে সড়ক পথে শিলং যাওয়ার আবহ। বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দুই ঘণ্টা ড্রাইভ। অবশেষে পকোনোতে নির্ধারিত ভিলায় পৌঁছলাম আমরা। সহযাত্রী অন্যরা ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছেন।
সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি তিন তলা ভিলা। অনেক সুন্দর, অনেকটা পুরোনো দিনের জমিদারদের শৌখিন বাড়ির মতো। ভিলার সামনে রাস্তা। রাস্তার পাশেই নজরকাড়া লেক। ভিলার বারান্দায় বসেই লেকের সৌন্দর্য অবগাহন করা যায়। বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ছিল। বারান্দায় না বসে ভেতরে গিয়ে ফায়ার প্লেসে আগুন দিয়ে গোল হয়ে সবাই বসলাম। রাতভর চলল আড্ডা আর গান। সঙ্গে চা নাশতা। কেউ গান গেয়েছেন, কেউ কণ্ঠ মিলিয়েছেন। আমরা বাকি যারা থাকলাম, তারা তালি বাজিয়ে ও নেচে শিল্পীদের উৎসাহিত করছিলাম।
রাত দুটো হবে, হঠাৎ নিচে দরজায় খট খট আওয়াজ শুনে আমরা সবাই একসঙ্গে নিচে নেমে দরজা খুলেই হতভম্ব। দেখি, একঝাঁক হরিণ সামনের খোলা চত্বরে ঘাসের ওপর বিচরণ করছে। এর মধ্যে একটা বড় হরিণ মনে হয়, সরাসরি দরজায় এসে আঁচড় কাটছিল। আমরা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আকাশে অর্ধেক চাঁদ জ্বল জ্বল করছে। আকাশজুড়ে অসংখ্য তারার ঝলমলানি। সারা দিন বৃষ্টির পর পরিষ্কার আকাশ। মেঘের একটি চিলতেও নেই। চাঁদের আলতো ছায়া লেকের স্বচ্ছ পানিতে পড়ছে। এ এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। চাঁদের আলো, গাছের ছায়া, মধ্যরাত, একঝাঁক হরিণ—আমাদের সঙ্গে থাকা সাত রমণী। সব মিলে ভাব বিলাস আর রহস্যের এক অদ্ভুত ভালো লাগা। খোলা আকাশের নিচে হাতে হাত ধরে লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সড়ক পথ। মধ্য বয়সের সাত দম্পতির মধ্যরাত পেরোনো বিহার। হাঁটতে থাকলাম। আকাশে চাঁদ, শীতের মৃদু বাতাস।
স্থান–কাল ভুলে যাওয়ার ভাব বিলাসে পেনসিলভানিয়ার বুনো পাহাড়
পকোনোর নির্জন এক সড়কপথ। ১৪ জনের আনমনে রাত। নারীরা গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে...।’ অসম্ভব ভালো লাগা মন নিয়ে আমরাও তাদের সঙ্গে ঠোঁট মেলালাম।