করোনা ভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিতে স্থবিরতা, শেয়ার বাজারে ধস। রাশ টেনে ধরতে কংগ্রেস ট্রিলিয়ন ডলারের সাহায্য কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সামগ্রী জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহের লক্ষ্যে যুদ্ধকালীন উৎপাদন আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও অবস্থা পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দুই প্রধান ঘাঁটি। ফেডারেল প্রশাসনের অক্ষমতার কারণে এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন নিউসাম ও নিউইয়র্কের গভর্নর এন্ড্রু কুওমো হয়ে উঠেছেন দুই প্রধান তারকা। তাঁরা উভয়েই কোনো রাখঢাক ছাড়াই জানিয়েছেন সামনে কঠিন দিন আসছে। আগামী দুই মাস বা তার চেয়েও লম্বা সময় লাগবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে।
গভর্নর নিউসাম তাঁর রাজ্যের চার কোটি মানুষকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না আসার নির্দেশ দিয়েছেন। অধিকাংশ অফিস-আদালত বন্ধ, ঘরে বসে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশের আওতায় শুধুমাত্র খাদ্য ও ওষুধ ক্রয়ের জন্য ও জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের ঘরের বাইরের আসার অনুমতি রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য এই নির্দেশ বলবৎ থাকবে, যারা অমান্য করবে তাদের জন্য রয়েছে জরিমানা, প্রয়োজনে কারাবাস।
নিউসাম বলেছেন, সরকারি নির্দেশ যথাযথ না মানা হলে রাজ্যের ৫৬ শতাংশ মানুষ, বা দুই কোটি ২০ লক্ষ মানুষ, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই রাজ্যে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় এক হাজার, মারা গেছে ৬৭৫ জন।
নিউইয়র্কের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। এ পর্যন্ত জানা গেছে এমন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ব্যাপক হারে পরীক্ষা শুরু হওয়ায় দ্রুত বাড়ছে এই সংখ্যা। মারা গেছে এমন মানুষের সংখ্যা, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৬। এখনো অনেক মানুষ পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়েছে, ফলে প্রকৃত আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশি, এ কথা বলেছেন গভর্নর কুওমো। শুক্রবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০০।
অবস্থা সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভাইরাস প্রতিষেধক মাস্ক, রেস্পিরেটর ও ভেন্টিলেটর। সারা দেশেই এই সব সামগ্রীর অভাব। সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এ কারণে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন। পরিস্থিতির সঠিক চিত্র না তুলে ধরা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের জন্য ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে সমালোচিত হয়েছেন। নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন, ‘অবস্থা সামাল দিতে অবিলম্বে সেনা বাহিনী মোতায়েন করা উচিত। আমাদের রয়েছে বিশ্বের সেরা সামরিক বাহিনী। তাদের এই মুহুর্তে কাজে না নামানো হচ্ছে একটি নির্বোধের মত কাজ।’
অব্যাহত সমালোচনার মুখে ট্রাম্প প্রশাসন নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য দুটি সামরিক ভাসমান হাসপাতাল প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী দ্রুত পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে দাবি করা হলেও বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রবল ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে একই জিনিস একাধিকবার ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ‘পলিটিকো’। এই ওয়েব পত্রিকার কাছে একাধিক চিকিৎসা কর্মী বলেছেন এটি খুবই বিপজ্জনক একটি ব্যবস্থা। চিকিৎসা কর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও ভীত। অনেক স্থানে ভাইরাস-আক্রান্ত ডাক্তার ও নার্সদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। নিউইয়র্কের নার্স এসোসিয়েশনের একজন সদস্য বলেছেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়া একটা দুঃস্বপ্নের মত ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
সব বিশেষজ্ঞই বলছেন, অবস্থা ভাল হওয়ার আগে তা আরও অনেক খারাপ হবে। পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আরো অধিক সংখ্যায় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ঘরের ভেতরে থাকা ও যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে দেশের সর্বত্র ‘ড্রাইভ-থ্রু’ পরীক্ষা কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। এইসব কেন্দ্রে গাড়িতে বসে থেকেই ভাইরাস রয়েছে কিনা তার পরীক্ষা সম্ভব। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের প্রথম ‘ড্রাইভ-থ্রু’ পরীক্ষা কেন্দ্র খোলা হয়েছে স্টাটেন আইল্যান্ডে। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে সাতটা পর্যন্ত এখানে এই পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে।