আমরা জানি, মহাকালের আবর্তে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। কিন্তু আমরা কি জানি, মহাকালের আবর্তে কোনটি খুব সহজে আর কোনটি সহজে হারিয়ে যায় না? সবচেয়ে সহজে হারিয়ে যায় ব্যর্থ ব্যক্তিরা। আর সফল ব্যক্তিরা সহজে হারিয়ে যায় না। এবার জীবনে সফলতা এবং ব্যর্থতার সংজ্ঞাটি সম্পর্কে কিছু জানি। পরীক্ষা পাস না করাকে ব্যর্থতা বলা হয় না। আবার পরীক্ষায় পাস করাকে জীবনের সাফল্য বলা যায় না। জীবনে সফলতা হচ্ছে সর্বদা জীবনযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ এবং সর্বদা প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে থাকা। জীবনের প্রতিযোগিতায় কিছু সময় দ্রুত দৌড়ানোকে আবার সাফল্য বলা যায় না।
যেমন ধরুন, এসএসসিতে জিপিএ–৫, এইচএসসিতে জিপিএ৫, স্নাতকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ এবং এরপর বিসিএস পাস করে একটি চাকরি করে জীবনে পুরোদমে থিতু হওয়া শুধু জীবনের প্রতিযোগিতায় দ্রুত দৌড়ানো হয়। জীবনে থিতু হওয়া বলতে কিছু থাকা উচিত নয়। কিন্তু অনেকেই সামান্য অর্জনে আত্মতুষ্টিতে ভোগে এবং জীবনে অর্জনের পথে তাদের পথচলা বন্ধ করে দেয়। বিস্মিত হলেও এ কথা সত্য, বেশির ভাগ মানুষ সহজেই আত্মতুষ্টিতে ভোগে। এরা জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী কিছু পেলে বা তার চেয়ে বেশি কিছু পেলে জীবনের প্রতিযোগিতায় দৌড়ানো বন্ধ করে দেয়। তারা মনে , আর পরিশ্রম করে কি লাভ? আমি জীবনে যা চেয়েছি তাই তো পেয়েছি! অথবা আমিতো জীবনে অনেক কিছু করেছি, আর কত? এটা বাস্তবিকে ব্যর্থতার লক্ষণ মাত্র। মহাকালের আবর্তে এদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। জীবনযুদ্ধ চলমান এবং যারা এই যুদ্ধে কিছু পেয়ে থেমে যাবে, তারাই প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ।
প্রাচীন যুগের রাজা–বাদশাহদের কথা একটু ভেবে দেখুন। কত রাজা–বাদশা এই ভুবনে রাজত্ব করেছে। কিন্তু আসলে ইতিহাস কয়জন রাজাকেইবা মনে রেখেছে? আবার কয়েকজনইবা আলেক্সান্ডার দি গ্রেট, আকবর, চেঙ্গিস খান, অশোকা, অগাস্টাস বা হুমায়ুন হতে পেরেছে। এরা রাজ্যের পর রাজ্য জয় করেছে এবং বহুবার যুদ্ধে পরাজিতও হয়েছে। কিন্তু তারা জীবনের প্রতিযোগিতায় থেমে থাকেননি। তাই আজ তারা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছেন। তাঁরা ইচ্ছে করলে একটি রাজ্য জয় বা পরাজয়ের পর ক্ষান্ত হতে পারতেন কিন্তু তাঁরা সেটা করেননি। আর সে জন্যই শত ব্যর্থতার মধ্যেও তাঁরা সফল। তেমনি আমাদেরও জীবনযুদ্ধে সর্বদা অংশগ্রহণ করে যেতে হবে। নিজেকে কীভাবে আরও ভালো করা যায় বা নিজেকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে।
জীবনে উন্নতির কোন সীমানা নাই। তাই অযথা আপনার জীবনে লক্ষ্য ঠিক করে উন্নতির সীমানা দেবেন না। এতে আপনি লক্ষ্য অর্জনে সফল হলেও বাস্তবে আপনি ব্যর্থ হবেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, জীবনের লক্ষ্য অর্জন মানে সব কাজ শেষ নয়। জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তনশীল। জীবনের একেকটি লক্ষ্য একেকটি ধাপ মাত্র। সেটা বুঝে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য মানে অর্জনের শেষ সীমানা নয় বরং জীবনযুদ্ধের শুরু মাত্র।
মাশরাফির জীবন থেকে শিখুন। একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাঁর অর্জন অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাঁর যে অর্জন, এতে তিনি নিশ্চিন্তে সারাটা জীবন আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নতুন একটি লক্ষ্য স্থির করেছেন এবং তাঁর লক্ষ্যে সফলও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য এখানেই সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত নয়। তাঁর আরও নতুন নতুন লক্ষ্য স্থির করে সে লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। তাহলেই ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
জীবনে লক্ষ্য স্থির করে অর্জন না করাকে ব্যর্থতা বলা হয় না। কিন্তু লক্ষ্যের পেছনে না হাঁটাকে ব্যর্থতা বলা হয়। জীবনটা আসলে এক শ মার্কের একটি নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার মত। আইনস্টাইন, গান্ধী, নেপোলিয়ান, জর্জ ওয়াশিংটন, শেক্সপিয়ার, ডারউইন প্রমুখ যারা এই পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মার্কস পেয়েছেন। অনেকেই জানে, ৩৩ মার্ক পেলেই এই পরীক্ষায় পাস করা যায়। যেমন বিসিএস পরীক্ষায় পাস করা জীবনের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় ৩৩ মার্কসের সমান। কিন্তু কোনোরকমে ৩৩ পেয়ে পরীক্ষায় পাস করলে সে ছাত্রছাত্রীকে কয়জন শিক্ষকইবা মনে রাখে?
এখানে মহাকাল আমাদের শিক্ষকই বটে। এক একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন জীবনের একেকটি লক্ষ্যের মত। প্রথম নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর আপনাকে সঠিকভাবে দিতে হবে, এমন নয়। জীবনে এই রকম অনেক নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন আসবে এবং প্রস্তুতি নিয়ে সেগুলোর সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কিছু ছাত্র–ছাত্রী যখন মনে করে, তার প্রথম কয়েকটি প্রশ্ন খুব কমন এসেছে তখন তারা পরবর্তী প্রশ্নগুলো তেমন সিরিয়াসলি নেয় না। কারণ তারা জানে, পরীক্ষায় তারা পাস করবে। এটা আত্মতুষ্টির লক্ষণ, যা আত্মহত্যার শামিল। আবার অনেকে পরীক্ষার প্রথম কয়েকটি প্রশ্ন না কমন আসলে হতাশ হয়ে পড়ে এবং সিরিয়াসলি পরীক্ষাটা শেষ করে না। কারণ তারা মনে করে, পরীক্ষা দিয়ে কি লাভ? আমি তো পাস করব না। আবার অনেকে পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্নে এত সময় নেয় যে, সব প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে পারে না। তেমনি জীবনযুদ্ধে অনেক ব্যক্তি আছে, জীবনের শুরুতে অনেক সাফল্য পায় এবং পরে আর কিছু করে না বা আত্মতুষ্টিতে ভোগে। অনেকে জীবনের শুরুতে ব্যর্থতা পেয়ে পেয়ে জীবনের পথচলা বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা সারা জীবন ব্যর্থই থেকে যায়। আবার অনেকে একটি লক্ষ্যের পেছনে এত সময় ব্যয় করে যে, অন্য কিছু করার আর তাদের সময় থাকে না।