ধরুন আপনার বাবা কিংবা মা কিছুটা বদমেজাজি, খিটখিটে। আপনার সঙ্গে অনেক কিছুতেই হয়তো বনে না কিংবা তারা যুগের চেয়ে অনেকখানি পিছিয়ে। কোনোভাবে আপনি তাকে আধুনিক করতে পারছেন না! তবে কি আপনি বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে থাকবেন? সপ্তাহান্তে একবার ফোন করেই কিংবা ছয় মাসে এক বছরে দেখা করেই ধরে নেবেন আপনার দায়িত্ব শেষ! কিন্তু সেই আপনি হয়তো নিজের সন্তানের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারেন! তখন কি মনে হয় না, আপনার বাবা-মাও ঠিক এভাবে ভালোবাসেন আপনাকে! যখন আপনার নিজেরও বয়স হবে, বাবা-মা পৃথিবীতে থাকবে না, তখন এই করতে না পারার অপরাধগুলো আপনার ফিরে আসবে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে হয়তো হাউ মাউ করে কাঁদবেন। কিন্তু যা চলে গেছে তাতো আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন না! এ জন্যই বলি, সময় থাকতে সচেতন হোন। বাবা-মায়ের সেবা করুন। সুযোগ পেলেই তাদের সময় দিন।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি নিজেকে অসম্ভব সৌভাগ্যবান মনে করি এজন্য, বিয়ের এত বছর পরও আব্বা-আম্মা, স্বামী-সন্তানসহ এক বাসায় থাকি। এমন নয়, আমি তাদের জন্য অনেক কিছু করেছি, বরং তারাই সেই জন্ম থেকে আজ অবধি শুধু আমার জন্য করেই যাচ্ছে। আমার সন্তানদের বড় করেছেন আমার আম্মা। যে কারণে কম বয়সে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পেরেছি। ভালো চাকরি করতে পেরেছি। সৃষ্টিশীল কাজেও তারা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করেন। যখনই লিখতে বসি দৌড়ে গিয়ে বলি, আব্বু কিছু লিখছি নাকি যা তা হচ্ছে। আব্বু উৎসাহ দিয়ে বলেন, চারদিকে যা কিছু দেখো পুরোপুরি দেখবে। লিখতে বসে চোখ বন্ধ করে সেই ভালো মন্দ সব নিজের মতো করে দেখবে, তাকে সাজাবে এরপর কাগজে–কলমে সহজ ভাষায় তা লিখে ধরে রেখো, দেখো লেখার সৌন্দর্য বের হয়ে আসবেই। আব্বুর কথামতই মাঝে মাঝে লিখে যাই।
আব্বুকে ছোটবেলা থেকে কখনো অসুস্থ হতে দেখিনি। কিছুদিন যাবৎ আব্বুকে মনমরা আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেদিন কাজে যাওয়ার সময় আব্বুকে দেখলাম বারবার হাত দেখছেন। ভাবছি বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই আব্বুর কাছে বসে
একসঙ্গে সময় কাটাব। কাজ থেকে ফিরে মেয়ের পাশে শুয়ে আছি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবু ভাইয়া কি করলেন সারা দিন? মেয়ের উত্তর শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলে, দৌড়ে গেলাম আব্বুর কাছে। ফ্যাকাশে মুখে শুয়ে আছেন। বললাম উঠে এসো। বাধ্য ছেলের মতো উঠে এলে বললাম, চলো ‘ব্রিদিং এক্সারসাইজ’ করবে। একটা ব্রিদ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্বু পড়ে গেলেন; সঙ্গে সঙ্গে উঠেও বসলেন। হয়তো ভুল দেখেছি ভেবে এড়িয়ে গেলাম। দ্বিতীয়বার যখন পড়ে গেলেন, তখন পাগলের মতো চিৎকার করে ৯১১–এ কল দিতেই ইএমসের টিম চলে এল। ওরা এসে বলল, কিছু হয়নি। কোন হাসপাতালে চেকআপের জন্য নিয়ে যাব? আমরা বললাম মাউন্ট সাইনাই হসপিটালে। জীবনে প্রথম অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে হাসপাতালে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এ যুদ্ধে আমাকে জিততেই হবে। তখনো বুঝিনি এত সহজ হবে না। হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আব্বু লাইফ সাপোর্টে চলে যাওয়ার আগে হাত চেপে ধরে বললেন, তুমি ভেঙে পড়ছ—এটিই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। খুব ভালো করেই জানি, তোমার মাকে দেখবে তুমি, তবুও বলি খেয়াল রেখো।
হঠাৎ আমার সব কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল; ভালোবাসা, হাসি-কান্না, চারপাশটা। এরপর আমার যুদ্ধ শুরু হলো। লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার পর থেকে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা, ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা।’ হে আল্লাহ আমার বাবা–মাকে হেফাজতে রাখুন। অ্যাস্টোরিয়া থেকে ম্যানহাটন, ম্যানহাটন থেকে উডসাইড রিহ্যাব, রিহ্যাব থেকে এলমহার্স্ট হাসপাতাল; সেখান থেকে আবার ম্যানহাটনে যাওয়া–আসা করে একসময় ক্লান্ত আমি বিজয়ীনির বেশে আব্বুকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামার পথে যখন ডিসচার্জ নার্সকে দেখতে পাই, তখন খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি ‘বিদায় বন্ধু’। এই নারী নার্স আব্বুকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি অনেক ভাগ্যবান। তোমার মেয়ে তোমাকে তাড়াহুড়ো করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এখানে অনেক বাবা-মা আছেন, যাদের ছেলেমেয়েরা চতুর্থবারেও না করে দিয়েছেন ঘরে ফিরিয়ে নিতে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। চোখ ভিজে উঠে নিজের অজান্তে, বুক ভারী হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
যাদের ছাড়া জীবন মূল্যহীন, যাদের ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না, তাদের এমন কারাগারে রেখে বাঁচব কিভাবে? জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ততাকে অনেকেরই আপন করে নিতে হয়। তবুও একই ছাদের নিচে থেকে বাবা মায়ের সান্নিধ্য যারা পায় না, যারা কখনো নিজের বুকের ভেতর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না, তাদের চেয়ে হতভাগা সন্তান আর কে হতে পারে? এক স্বর্গীয় আত্মতৃপ্তি নিয়ে জীবনের সব দুঃখ–হতাশাকে তুড়ি মেরে পেছনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আব্বুকে নিয়ে বের হয়ে আসি বীরাঙ্গনার বেশে।