আসলেও বাঙালির নিজস্ব পোশাক বলতে কিছু ছিল কি? বাঙালি সমাজে তো আবার বিভাজনের একটা রেখা দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছিল সব শ্রেণির মানুষকে। তার এক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হিন্দু সমাজ, অন্যদিকে মুসলমান সমাজ। হিন্দুদের মধ্যে আবার জাতপাতের বাছবিচার তো ছিলই। মুসলমানদের মধ্যে আছে আশরাফ-আতরাফ সমস্যা। ফলে শ্রেণিবিভক্ত জাতির মধ্যে মাঝবরাবর একটা বিভক্তির রেখা সূক্ষ্মভাবে বিরাজমান ছিল।
পুরুষের সাজপোশাকে ধর্ম একটা ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন মুসলমান পুরুষেরা সাধারণত ঘরে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাইরে লুঙ্গি পরে থাকলেও বাইরে সচরাচর পায়জামা ও পাঞ্জাবিই পরে থাকেন। আর যদি ভালো কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার দরকার হয়, তবে প্যান্ট আর শার্ট হলো তাঁদের মানানসই পোশাক। আবার বিয়েবাড়িতে যেতে হলে সাবেকি ঘরানার সাহায্য নিতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। সেই পোশাকটা হচ্ছে শেরওয়ানির সঙ্গে চোস্ত পায়জামা, যাকে বলা হয়ে থাকে চুড়িদার।
হিন্দু সমাজে বিয়ের সময় পুরুষেরা শেরওয়ানি পরলেও এই পোশাকটাকে আমলে নেয় না। ধুতি-পাঞ্জাবিই হচ্ছে তাদের পরিধেয় বস্ত্রের মধ্যে পরিচিত পোশাক। তবে এই পোশাকটা প্রবীণদের জন্য মানানসই হলেও যুবক সম্প্রদায়ের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি কখনো। যদিও বিয়ের বরকে পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি পরতে দেখা যায়। আগেকার সময়ে এই ধুতির রং সব সময় সাদা থাকলেও বর্তমানে ধুতির কালারফুল ব্যবহার অনেক বেশি সুন্দর। একসময় মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্ত পুরুষেরাও কিন্তু ধুতি পরতেন।
হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে
নারীদের সাজপোশাকের অন্যতম বস্ত্র হলো শাড়ি। ঘরে শাড়ি, বাইরে শাড়ি, শাড়ির যে কত রকমফের, তার আর যেন শেষ নেই। হিন্দু নারীদের শাড়ি পরার ঢং আবার মুসলিম নারীদের চাইতে আলাদা ছিল একসময়। সামনে কুঁচি না দিয়ে হাতের নিচ দিয়ে পেঁচিয়ে পরার ওই রীতিটা আগেকার সময়ে কোনো কোনো মুসলমান নারীকে অনুসরণ করতে দেখা গেলেও ব্যাপকভাবে তার প্রচলন হয়নি। তবে ঠাকুরমা, দিদিমাদের আমলে প্রচলিত ছিল এই ধরনের শাড়ি পরার ঢং। কিন্তু হিন্দু নারীদের কাছে আবার এই ধরনটা জনপ্রিয় ছিল না। যদিও এভাবে পরতেন অনেকে, তবে সেই পরার সঙ্গে ব্লাউজ কিংবা পেটিকোট পরার কোনো রীতি ছিল না।
নারীদের মধ্যেও শ্রেণিবিন্যাস ছিল। যাঁরা মহলে বাস করেন, তাঁরা হলেন মহিলা। অন্যদিকে সর্বজনীন যে নারীসমাজ, যাদের অবস্থানগত পরিচয় হচ্ছে নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষ হিসেবে, তারা মাঠে-ঘাটে ধান রোপণ-মাড়াই থেকে শুরু করে সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি শ্রম দিয়ে থাকেন, তাঁরা কিন্তু ওই ধরনের কুঁচি ছাড়া হাত পেঁচিয়েই শাড়ি পরেন এখনো। ব্লাউজ-পেটিকোটের বালাই থাকে না তাঁদের সাজপোশাকে। কারণ, ওই শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। যেখানে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’।
মুসলিম সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা অন্য মাত্রার, যেমন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর এক লেখায় বড় বোন করিমুন্নেসাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইলেকট্রিক বাতিকে স্তরের পর স্তর অর্থাৎ অনেক কাপড়ের আবরণে ঢাকিলে যেরূপ অন্ধকার দেখায়, আমার বোনটাও সেইরূপে কাপড়ের চাপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।’ তার এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে তৎকালীন মুসলিম সমাজের চিত্রটা ফুটে উঠেছে, অর্থাৎ পর্দাপ্রথার আবরণে নারীর হাঁসফাঁস করে বাঁচার করুণ এক অধ্যায়। সেখানে শাড়ি পরলেও লম্বা হাতার ব্লাউজ, তার ওপর আরেক প্রস্থ কাপড় দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল।
শাড়ি নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। হিন্দু সমাজের প্রচলিত নিয়ম ছিল সেলাই করা কোনো কাপড় পরে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে বসতে পারবেন না মেয়েরা। এই ধরনের একটা ঘটনার খবর হলো, ১৯০১ সালে ঠাকুরবাড়ির গগনেন্দ্র নাথ যখন নয় বছর বয়সী কন্যা সুনন্দিনীকে সম্প্রদান করতে যাচ্ছিলেন, তখন বরপক্ষের একজন আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘সেলাই করা কাপড় পরে মেয়ে সম্প্রদান করা যাবে না।’ গগনেন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ের গায়ে কোনো ব্লাউজ বা পেটিকোট নেই বলে পার পাননি, তিনি দেখিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, শাড়িটা সুনন্দিনী পরেছেন অন্যভাবে।
আধুনিক ধরনে শাড়ি পরার ক্ষেত্রে আইসিএস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর ভূমিকা ছিল ব্যাপক। তিনি তাঁর স্বামীর কর্মস্থল বোম্বেতে গিয়ে প্রথমেই জবরজং ওরিয়েন্টাল পোশাক বর্জন করে পারসি মেয়েদের শাড়ি পরার ছিমছাম ধরনটি গ্রহণ করেছিলেন। কলকাতায় ফিরে তিনি কাগজে ওই ধরনের শাড়ি পরার রীতি শেখানোর বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর পেটিকোট, শেমিজ, ব্লাউজ ও জ্যাকেট পরার রীতিও প্রচলন করেছিলেন। ওই ঢংকে বলা হতো ‘বোম্বাই দস্তুর’।
বর্তমান সময়কালে যদিও প্যান্ট-ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষ করে যাঁরা বাইরে কাজ করেন, তাঁদের জন্য এই ধরনের পোশাক কাজের উপযোগী ও আরামদায়ক। তারপরও শাড়ির কদর কমেনি বাঙালি সমাজে। যেকোনো পালা-পার্বণে, বিয়ে-শাদি থেকে মুখে ভাত-জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী—সব জায়গায় সেই শাড়ির প্রাধান্য দেখা যায়। বিশেষ অনুষ্ঠান সামনে রেখে, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাদাকালো, বসন্ত উৎসবে বাসন্তী রং, স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে লাল-সবুজের সমাহার দেখা যায়। তবে বাংলা নববর্ষে লাল-সাদা শাড়ি পরেন না, এমন বাঙালি নারী বিরল। শাড়ির আঁচলে ফুটিয়ে তোলা হয় বাঙালি শিল্প ও সংস্কৃতির আঁচড়। নারীরা যেমন শাড়িতে, তেমনি বাঙালি পুরুষেরা ফতুয়া কিংবা পাঞ্জাবিতে সবাইকে জানিয়ে দেন তাঁর জাতিসত্তার শিকড়কে।