>মা তাহরিনা পারভীন প্রীতি কবিতা আবৃত্তি করেন, মেয়ে তাহিয়াত অধরা গান করেন। প্রবাসে থেকেও তারা ভুলে যাননি নিজের দেশের সংস্কৃতি, ভুলে যাননি নিজের শিকড়কে।
খুব ছোটবেলায় খেলাধুলা করে ক্লান্ত হয়ে স্কুলের বা পাড়ার মিউনিসিপ্যালটির টিউবওয়েল থেকে অনেকক্ষণ পানি পাম্প করার পর ঠান্ডা পানি আঁজলা ভরে খেতে কী যে আনন্দের ছিল! কী যে শান্তি! কী যে তৃপ্তি! নিউইয়র্কে আসার পর থেকে প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে এলিভেটরে ওঠা–নামা, স্কুলে ঢোকার মুখে ক্রসিং গার্ড থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী আর সহকর্মীদের ‘গুডমর্নিং’ বলতে বলতে শুরু হওয়া দিনে ইংরেজি, ইংরেজি এবং ইংরেজিই একমাত্র ভাষা। আজও একই রকম। ৫–৬ ঘণ্টা পর আজ যখন চারপাশে ইংরেজি শুনতে শুনতে ক্লান্ত তখন আমাকে স্কুল থেকে পিক আপ করতে আসা আমার স্বামীর গাড়ির দরজা খুলতেই ‘-যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার’—কুমার বিশ্বজিতের বাংলা গানটি কানে এল। আহা আমি যেন সেই আঁজলাভরা পানি পান করার সুখ পেলাম। আহা বাংলা, আসলে কী মধুর এই ভাষা। মন প্রাণ ভরে গেল মুগ্ধতায়। আঁজলাভরা জল যেমন তৃষ্ণা মেটাতো, তেমনি মনটা জুড়িয়ে গেল। প্রবাসী মানুষের কাছে দেশ আর দেশের ভাষা কি এক আকুলতা, তা প্রবাসীরা ছাড়া আর কেউই বুঝবে না। বাংলা কথা শোনার জন্য, বাংলায় কথা বলার জন্য মন যেন পিপাসার্ত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলায় কথা বলার অধিকার পেতে বাঙালি রক্ত দিয়েছিল সেই ১৯৫২ সালে। ভাষার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে পিছপা হননি বঙ্গ সন্তান রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম। তাঁদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ।
তারও আগে পূর্ব আর পশ্চিম দুই পাকিস্তান আর ভারত নিয়ে যখন এই উপমহাদেশ, তখনো ছিল বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, সুকান্ত ভট্টাচার্য আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। আমরা আনন্দে, বেদনায়, প্রতিবাদে, জয়ে কিংবা পরাজয়ে বেছে নিতে পারি যেকোনো গান বা কবিতা।
১৯৭১ আমাদের অহংকার। স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম শক্তি ছিল বাংলা গান। মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে, স্বাধীন বাংলা বেতারের সেই ক্ষুদ্র পরিসরে, নানা অনিশ্চয়তা, প্রতিবন্ধকতা ও কারিগরি সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেভাবে অসাধারণ সব রক্তে অনুরণন জাগানো গানগুলো রেকর্ডিং করে সম্প্রচার করা হয়, তা অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সাহায্যার্থে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ১৯৭১-এর ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এই আয়োজনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অন্যতম ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। কনসার্টে অনেকের মধ্যে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন, তাঁর গানের শিরোনাম ‘বাংলাদেশ’। এই গানের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামে নতুন সুর। ‘বাংলাদেশ ধুন’ যুগলবন্দী বাদনে রবিশঙ্করের সঙ্গে আলী আকবর খাঁ সেদিন অসাধারণ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন।। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগিয়েছিল এই কনসার্ট।
আপেল মাহমুদের কণ্ঠে গাওয়া ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটির কথা ও সুর এমন যে, রক্তে উন্মাদনা তৈরি করে এই গান। এই ঐতিহাসিক গানটি এমন এক গান, যা কথার সৌকর্যে, সুরের মোহনীয় আর শিল্পীর দরদি কণ্ঠের আবেগে এক দ্বিধাহীন অমরত্ব পেয়েছে। অনেক শিল্পীই গানটি শুরু করেন মাঝখানের সেই অসাধারণ লাইনটি দিয়ে
—‘যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা, যার নদী-জল ফুলে-ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা...’। কী অসাধারণ এই পঙ্ক্তিমালা।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে। হবে নিশ্চয়’
‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি
দেব রে। আমরা কজন নবীন মাঝি’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালির জীবনের অন্যতম একটি চালিকা শক্তি ছিল এই গানগুলো। এই গানগুলো প্রচারে শত বাধা-বিপত্তি থাকলেও তাদের একাগ্রতার কারণে এসব গান ঠিকই পৌঁছে গিয়েছে কোটি-কোটি মুক্তিকামী মানুষের কানে, পৌঁছে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা ভাঙা বেতারে। চারপাশে যখন গণহত্যার খবর, তখন বাঙালিদের ভেঙে পড়তে দেয়নি এই গানগুলো। সাহসী হতে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। আরও বেশি সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে উজ্জীবিত করেছে বারবার। প্রিয়জন হারানোর খবর পাওয়া, হৃদয়ভাঙা যোদ্ধার মনকে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দিয়ে পরের যুদ্ধের জন্য তৈরি করে দিয়েছে, সাহসী করে তুলেছে এসব গান। আর এসব গান বিদেশ বিভুঁইয়ে আমরা যারা ছড়িয়ে আছি, আমাদের মন ও মননে প্রশান্তি বুলিয়ে দেয়।
প্রবাসে যারা বসবাস করেন, তাদের মনের ভেতর আকুল আরেক হৃদয় থাকে। যেখানে দেশের প্রতি থাকে এক আকাশ ভালোবাসা। দেশের একজন মানুষ পেলে দুটো কথা বলে মন ভোলান। নিউইয়র্কে বার্গার কিং, সেভেন ইলেভেন, ডানকিন ডোনাটস, ম্যাকডোনাল্ড, ফাস্ট ফুড দোকানগুলো বাংলাদেশিদের দিয়ে চলে। সেখানে কফি কিংবা চা আর বার্গার বা স্যান্ডউইচের সঙ্গে দুটো বাংলা কথা যেন বোনাসসম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি। প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা বায়ান্ন। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীত স্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। আমাদের প্রেমে, বিরহে, মিলনে, দুঃখে আনন্দে আমরা রবীন্দ্র সংগীতে খুঁজে পাই আশ্রয়। আমাদের জাতীয় সংগীত
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি’
দৃপ্তকন্ঠে যখন কোথাও উচ্চারিত হয় আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হয় তখন। আমরা গর্বিত হই। আমরা হৃদয়ে ফেনিল ভালোবাসা অনুভব করি।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ এনেছিলেন তাঁর ভাষা শৈলীতে। বাঙালি মনীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন নজরুল। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ—দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষ, মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। আমাদের পরবাসী জীবনে যখনই কোনো অন্যায় অত্যাচারের সম্মুখীন হই, আমাদের মনে পড়ে ‘বিদ্রোহী’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের অন্যতম। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। গ্রাম বাংলার নিসর্গ ও রূপকথা সমপুরানের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় চিত্রিত হয়েছে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো। তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। তাই গ্রামবাংলা থেকে আসা প্রবাসীদের জীবন আলোকিত হয় তাঁর কবিতায়।
বাংলা কবিতা, গল্প বা গানে প্রবাস জীবনের অপূর্ণতাকে ভরিয়ে তুলতে প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে থাকে নানা আয়োজন। পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বইমেলা—সব কিছুই পালিত হয় বিপুল আয়োজনের মধ্য দিয়ে। পাঁচ দিন রোবটের মতো কাজ করেও সন্তানদের গান নাচ কবিতা শেখান বাবা–মা। দেশ, দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বাংলা স্কুলে শেখান। দেশ থেকে আসা খ্যাতিমান শিল্পীরা গান করেন, সঙ্গে প্রবাসী শিল্পীরাও গান, কবিরাও আবৃত্তি করেন। নানা ব্যস্ততার পরও সবাই ছুটে যান একটু মন জুড়াতে। দেশের গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, আঞ্চলিক গান, নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজন করা হয় জ্যাকসন হাইটস, কুইন্স বা ব্রঙ্কসে।
বাংলা আমাদের আনন্দ–বেদনার কাব্য। কাজের শেষে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোতে চায়ের সঙ্গে শিঙারা–সমুচা খেতে খেতে দেশের রাজনীতি নিয়ে তুমুল আড্ডা আর আলোচনা চলে। কোনো ফায়দা নেই জেনেও আওয়ামী লীগ বিএনপির সমর্থকেরা তর্কবিতর্ক করেন। পার্লামেন্টেও এত বিতর্ক হয় কিনা সন্দেহ। জমজমাট রেস্তোরাঁগুলোতে টিভি চ্যানেলে বাংলা গান বাজে।
‘মমতায় এ শিশিরগুলো জড়িয়ে ধরে পা
একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট
সোনার গাঁয়’
বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে বাজে বাংলা গান কিংবা কবিতা। হৃদয় জুড়েই থাকে দেশ। গ্রোসারিতে মাছ–মাংস কিনে দু-চারখানা বাংলা পত্রিকা হাতে করে ক্লান্ত প্রাণ বাড়ি ফিরে বাংলায়–ই স্বপ্ন দেখব বলে ঘুমিয়ে পড়ে।