বাংলাদেশি আমেরিকান টগরের গল্প

বাবার সঙ্গে লেখক শুক্লা রায়
বাবার সঙ্গে লেখক শুক্লা রায়

জীবনের তাগিদে প্রায় ষোলো বছর আগে দেশ ছেড়ে আমার আমেরিকায় চলে আসা। এখনকার মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, এখানে আমার থাকা হবে না। নেই আমার আপন কেউ, নেই পায়ে চলার পথ, নেই আমার দেশের মতো প্রকৃতি। নেই আম, জাম, কাঁঠাল, ডুমুর গাছ। নেই কৃষ্ণচূড়া, রাধাঁচূড়া, জারুল, টগর, স্বর্ণলতা। নেই দিগন্ত বিস্তৃত ধান খেত, সর্ষে খেত, শীতের ভোরের কুয়াশা। সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম। কোন কিছুতেই ঠিক মন লাগাতে পারতাম না।
এখনকার কোন গাছ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হত, আরে এটা ঠিক কাঠ মালতির মতো, এটার পাতাগুলো বড়ই পাতার মতো দেখতে, এটি একেবারেই বটগাছের মতো। সারাক্ষণ আমার বাংলাদেশকে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম এখনকার জীবন আর প্রকৃতিতে। একসময় এখনকার নার্সারিগুলোতে পেয়ে গেলাম দেশের কিছু গাছও। পেলাম জবা, গন্ধরাজ, বেলী। খুশি যেন আর ধরে না আমার। কিছুটা হলেও বাংলাদেশ চলে এল আমার নিউইয়র্কের ঘরে।
২০১৫ সাল বিশাল এক কষ্ট নিয়ে আমার জীবনে আসে। বাবা চলে গেলেন হঠাৎ করেই। ২০০৯ থেকে আমার কাছে আসতেন মা-বাবা দুজনেই। তবে বেশি দিন থাকতে চাইতেন না দেশ ছেড়ে। তিন/চার মাস হলেই ফিরে যেতে অস্থির হয়ে যেত। আমি আটকাতাম না। সেবার দেশ থেকে আসার তিন দিন পরেই বাবা চলে গেলেন। বাবাকে নিয়ে তার অন্তিম শয্যার জন্য আমার দেশে ফিরতে হলো। বাবা ছাড়া সেই আমার প্রিয় জন্মস্থান, আমাদের বাড়ি, এমনকি প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে থাকাটাও ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হলো। প্রতিটি ঘরে বাবাকে দেখতে পেতাম, বাবার গলা শুনতে পেতাম। একটু পর পর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হতো। মায়ের কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদতে হতো। দম বন্ধ হয়ে আসত। একা একা ছাদে গিয়ে বসে থাকতাম। বাবার শখের কবুতর, বাবার হাতে লাগানো গাছগুলো দেখে মনে হতো, বাবা পাশেই আছে। ছাদভর্তি বাবার লাগানো গাছ। কী নেই তাতে। আম, জামরুল থেকে শুরু করে গোলাপ, টগর, মালতি সব। টগর আমার পছন্দের একটি। ওখানে দাঁড়িয়ে টগর নিয়ে কত কথা হয়েছে আমার আর বাবার। টগর গাছটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম।
যা হোক, চলে গেল দুই সপ্তাহ। ফিরে আসলাম নিউইয়র্কে। বাবা আসতেন এখানে। বাবার স্মৃতি এখানেও রয়ে গেছে। কিছুতেই কোথাও ভালো লাগত না। সারাক্ষণ বাবাকে মিস করতাম। কোন কাজে মন বসাতে পারতাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা পরিবর্তন করার।
কিছুদিন পর একটু খোলা জায়গাসহ এক বাড়িতে চলে এলাম। সামারে সবজি চাষ করা শুরু করলাম। ফলন বেশ ভালোই হলো। গাছগুলো দেখতাম আর ভাবতাম, বাবা থাকলে ভীষণ খুশি হতো। বাবাই আমাকে গাছের প্রতি ভালোবাসা শিখিয়েছে, শিখিয়েছে ওদের যত্ন, কোন রোগ হলে কী করতে হবে। বাবার সঙ্গেই আমাদের ছাদবাগান করা। তবে আমাদের ছাদ বাগানে শুধু ফুল আর ফল গাছ থাকত। সবজি করা হতো না।
বাবার স্মৃতি তখনো আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। হঠাৎ মনে হলো, আমাদের ছাদবাগানের বাবার লাগানো সেই টগরের গাছের কথা। বন্যা আমার ভাইয়ের বউ, ওকে বলতেই সে আমাকে একটা টগরের কলামের চারা পাঠিয়ে দিল। সেটি ছোট করে গোড়া থেকে একটু ডাল রেখে কেটে তারপর কালো পলিথিনে মুড়িয়ে পাঠানো হলো। যাতে ইমিগ্রেশনে ধরা না পড়ে। একটু যত্ন নিতেই ডালপালা ছেড়ে ফুল এল। ওমা, এটা তো টগর নয়। এটা দেখি কাঠ মালতি। অনেকটা একরকম হলেও পাতা আর ফুলে একটু পার্থক্য রয়েছে টগর থেকে। কাঠ মালতির চেয়ে টগরের পাতা একটু বড় আর ফুলের পাপড়ি বেশ মোটা হয়। মনটা একটু খারাপ হলো। আবার কবে কাকে দিয়ে আনাব সেটা ভেবে।
হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা আমি তো বাবার লাগানো টগর গাছের থেকে ডাল এনে চারা করা যায় কিনা দেখতে পারি। বাড়িতে বলতেই একজনের সঙ্গে একটি ডাল কেটে দিয়ে দিল। সেটা আমার হাতে পৌঁছালে আরও কয়েক দিন পর। আবারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাঁচাতে পারলাম না।

বাংলাদেশ থেকে আনা চারায় আমেরিকার মাটিতে প্রস্ফুটিত টগর

মা বাংলাদেশে ছিলেন, এখানে আসবেন। বন্যার কাছে আবদার করলাম আবারও। তবে এবার আর একটা নয়, অনেকগুলো টগরের ডাল চাই। বলে দিলাম, ঠিক কেমন করে ডাল কাটতে হবে, কেমন করে সেগুলো লুকিয়ে দিতে হবে যাতে ইমিগ্রেশনে মাকে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। চলে এল টগরের ডালগুলো কোন ঝামেলা ছাড়াই। মা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাগ খুলে ডালগুলো বুকে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম, অন্তত একটারে যেন বাঁচাতে পারি। ভীষণ যত্নে ওদের মাটিতে লাগিয়ে দিলাম। প্রতিদিন সকালে উঠেই দেখতাম পাতা বের হচ্ছে কিনা। আর মন খারাপ করে কাজের পথে রওনা হতাম। ডালগুলো অনেক ছোট, তাতে নেই কোনো পাতা, আবহাওয়াও অনুকূলে নয়। ওদের বাঁচানো আমার অসাধ্য হলো প্রায়। ডালগুলোকে প্রায়ই হাত দিয়ে আদর করে দিতাম আর বলতাম, অন্তত একটা বেঁচে উঠুক।
তারপর এক রোববার, স্কুল নেই। একটু বেশি করে ঘুমিয়ে নিচ্ছি। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। দৌড়ে গেলাম টগরের ডালগুলো কাছে। দেখি একটি ডাল থেকে পাতা বের হচ্ছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মনে হল, বাবা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো খুব।
বাবার হাতে লাগানো গাছের ডাল থেকে আমার শিশু টগর গাছ। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকল। ছোট ছোট কচি সবুজ পাতায় ডালগুলোতে যেন প্রাণ ফিরে এল। সামার আসতেই শিশু টগরটিকে নিয়ে গেলাম বাইরে, যাতে সূর্যের কাছাকাছি থেকে ইচ্ছামতো ডালাপালা মেলে বড় হতে পারে। এবার অপেক্ষার পালা ফুলের জন্য। অবাক করে দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই চলে এল কুঁড়ি। তারপর কদিন পরেই আমার চার বছরের চেষ্টার, আমার সবচেয়ে অপেক্ষার দিনটি চলে এল। এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে একটি সাদা টগর ফুল। আমার বাবার হাতে লাগানো গাছের ডাল থেকে আমার টগর। মনে হয় এই শুভ্র সাদা ফুলে যেন আমার বাবার স্পর্শ রয়েছে। আমার ঘরে বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান টগরের জন্ম হলো।