অপরাধ করলে অপরাধীর বিচার হবে আইনের মাধ্যমে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটাই কাম্য। প্রায় সময় দেখি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের খবর। অপরাধী অস্ত্র তাক করে, ফলে পুলিশ তাকে পাল্টা গুলি ছুড়ে। সাধারণ মানুষের কাছে যা ‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত।
২০০৪ সালে যখন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হল, অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু হল। তখন থেকেই দেখে আসছি, যা এখনো চলছে। এই ‘ক্রসফায়ারের’ নামে কত নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, কে জানে? ব্যক্তিগত ঈর্ষা বা রাজনৈতিক ঈর্ষার কারণে অনেক সময় এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জনগণের ধারণা। কয়েক দিন ধরে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনা নিয়ে চলছে তোলপাড়। একজন সাবেক চৌকস সেনা অফিসারকে এভাবে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে পুরা দেশকে। কারণ সাবেক মেজর সিনহা ছিলেন একজন দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত অফিসার। তাঁর ছিল কমান্ডো ট্রেনিং। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসএসএফের (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) সদস্য ছিলেন।
এমন একজন চৌকস সাবেক সেনা অফিসারকে শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ সদস্যরা, তার ও সঙ্গের লোকদের ইয়াবা-গাঁজা নাটক সাজিয়ে বলা হচ্ছে মাদকের সঙ্গে জড়িত। যেমনটা অতীতে করা হয়েছে, অথচ ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন সৎ মানুষ। সমস্যা হল, একজন দক্ষ সাবেক সেনা কর্মকর্তা অন্য আর সাধারণের মতো নন, তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে যা বলা হচ্ছে, সাবেক মেজর অস্ত্র তাক করেছেন পুলিশের দিকে, তাই বাধ্য হয়ে তাকে পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত গুলি করেছেন, তা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে নিহতের বোন শারমিন নয়জনকে আসামি করে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন। সাত আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সবাইকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপ, লিয়াকতসহ ৭ পুলিশ (আসামিকে) সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
একটা রাষ্ট্রের জন্য দুই বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ। এই করোনাকালে আমরা দেখেছি পুলিশ কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে ছিল। তাই একজন ওসি প্রদীপ কুমার ও লিয়াকতের জন্য পুরো বাহিনীকে দোষ দেওয়া যায় না। তেমনি আমাদের সেনাবাহিনী দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে আমরা তাদের দেখি কীভাবে দেশের জন্য কাজ করে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তাদের সুনাম আছে। তাই মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার বিচার যেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় এবং তাঁর পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়। বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। দুই বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কেউ যেন ফায়দা নিতে না পারে।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, এত অল্প সময়ে চাকরি করে সিনহা কেন অবসর নিলেন, সেখানে কোনো রহস্য নেই তো! এ ব্যাপারে তার মা স্পষ্ট করেই বক্তব্য দিয়েছেন, সিনহার ইচ্ছা ছিল বিশ্ব ভ্রমণে যাওয়ার, বিভিন্ন ডকুমেটারি তৈরি করে মানুষকে দেখানো। বাইসাইকেলে করে জাপান যাবেন, করবেন এভারেস্ট জয়। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর সৌন্দর্য। অ্যাডভেঞ্চার স্বপ্ন লালন করেছিলেন মনো জগতে। এ জন্যই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আর বিশ্ব ভ্রমণে এ বছর যাওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে তা পিছিয়ে যায়। ফলে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম (সিফাত), শিপ্রা রানী দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত (নূর)—এই তিনজনকে নিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টারির কাজ করতে গিয়েছিলেন কক্সবাজার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁকে পুলিশের গুলি খেয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হয়। এমন বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হওয়া দরকার।
অতীতে এমন অনেক হয়েছে। টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাকে হত্যা করার আগে মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল একরামুলের, অবুঝ মেয়েটি বলেছিল, আব্বু তুমি কান্না করছ যে? সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়েছে কি? হলে হয়তো আজকে মেজর (অব.) সিনহার এই অবস্থা হতো না। ওসি প্রদীপ কুমারসহ অন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে উদাহরণ তৈরি হোক, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না ঘটে।
আমরা দেখেছি, কয়েক মাস আগে আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক হাতকড়া পরা অবস্থায় জর্জ ফ্লয়েড নামের কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিহত হয়। মৃত্যুর আগে জর্জ ফ্লয়েড বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, কষ্ট হচ্ছে।’ কিন্তু পুলিশ অফিসার শোনেনি। উল্টো হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে তাঁকে হাতকড়া পরানো হয়েছিল। ফলে জর্জ ফ্লয়েড মারা যায়। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে আমেরিকায়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের পুলিশ বাহিনী হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চায়, তবু থামেনি প্রতিবাদ। করোনাভাইরাসকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। অথচ এই পুলিশ আমাদের যেকোনো বিপদে, ইমারজেন্সিতে প্রথম এগিয়ে আসে। আমরা আমেরিকায় বসবাসকারীরা সহযোগিতা পাই এই পুলিশের কাছ থেকে। জর্জ ফ্লয়েডের এক ঘটনাই আমেরিকার পুলিশবাহিনী যেভাবে ক্ষমা চেয়েছে, আমাদের দেশে কি এমন হবে? আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী কি ক্ষমা চাইবে প্রদীপ, লিয়াকতের মতো পুলিশ সদস্যদের অন্যায়, অপরাধের জন্য? আমেরিকার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন পুলিশ বাহিনী নিয়ে। আসলে ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না, বরং মনের মধ্যে মানুষের যে ঘৃণা থাকে, তা দূর হয় অনেকখানি।
আমাদের দেশে ভালো পুলিশ নেই এমনটি নয়, পুলিশি সেবা না দিলে প্রতিদিন অপরাধের মাত্রা আরও বাড়ত। তবে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের বিস্তর অভিযোগ। এসব অভিযোগ একেবারে মিথ্যে তা নয়।
পরিশেষে বলব, পুলিশ হচ্ছে জনগণের সেবক, দেশের সেবক। তারা জনগণকে নিরাপত্তা দেবে। কোনো বিপদে পড়লে মানুষ পুলিশের কাছে সাহায্য চায়। আমরা ভাবি, তারাই আমাদের সহযোগিতা করবে। এমন পুলিশ অফিসারও দেখেছি, জীবনবাজি রেখে জনগণের জন্য কাজ করেছে। সত্যি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তখন মন থেকেই বলে উঠি, এইতো আমাদের পুলিশ বাহিনী। সত্যি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠে।
কিন্তু কোনো পুলিশ যখন নিরীহ কিংবা নিজের স্বার্থের জন্য অযথা কাউকে হয়রানি করে বা কাউকে ধরে পকেটে গাঁজা, ইয়াবা ঢুকিয়ে মাদকের মামলা সাজায়, তখন প্রাণ কেঁদে উঠে বলে, ছি, এই কি সেবকের নমুনা? টাকার লেনাদেনার হাট বসায়। না দিলে ক্রসফায়ার দেবে, এমন অভিযোগ জনগণের।
এমনও হয়েছে, যাকে জেলে দিয়েছে মাদকের মামলায়, দেখা যায় সত্যিকার অর্থে সেই লোক কখনো সিগারেটও খায়নি। হয়রানির শিকার তো হয়, সামাজিকভাবে হয় হেয় প্রতিপন্ন। লোকজন আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ওই জেলখাটা আসামি যায়। এটা একটা পরিবারের জন্য অনেক ব্রিবতকর এবং এর প্রভাব থাকে সারা জীবন। দোষী হোক বা না হোক, এই যে সমাজের মানুষের বিদ্রূপ, তা একজন মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়। পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দেবে, কিন্তু আইনের সেবক হয়ে বেআইনি কাজ করলে তাদের ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যায়।
যেমন দেখছি সিফাত, শিপ্রার বেলায়। সিনহাকে তো হত্যা করল, আবার তাঁর সঙ্গের লোকদের মাদকের মামলা সাজিয়ে কারাগারে দিয়েছে। তাদের অপরাধ কি? এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিনা অপরাধে এভাবে আটকে রেখে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডোবাবেন না, তাদের দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তি দিন। তাদের মুক্তি চাই। এরা দুর্নীতিবাজ নয়, গ্যাংস্টার নয়। এদের অতীত ইতিহাসে কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। অযথাই হয়রানি করা হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের।
আচ্ছা, সিনহা যদি সাবেক সামরিক অফিসার না হয়ে সাধারণ একজন নাগরিক হতেন, তাহলে কি এমন তোলপাড় হতো? নাকি অন্য ইস্যুর আড়ালে চাপা পড়ে যেত এই হত্যাকাণ্ড। কেউ হয়তো জানতই না বা জানলে ভয়ে চুপ করে থাকত, প্রকাশ পেত না। হয়তো অনেক ইস্যুর ভিড়ে এমন অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যা চাপা পড়ে যায়, যা পত্রিকার পাতায়ও আসে না। এভাবে যারা আপনজন হারায়, তারা জানে কি নির্মমতার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় যায়। নিহত সাবেক মেজর সিনহা ফিরে আসবে না। কিন্তু এসব তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার। কোনো মায়ের কোল খালি হোক, তা আমরা চাই না।