একসময়ের দেশের সেরা ব্যাংকারদের একজন। মুক্তিযোদ্ধা। যিনি ’৭১ সালে ঢাকায় থেকে যুদ্ধ করেছেন বীর বিক্রমে। দেশের একটি প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব নিয়ে পরিবারসহ গেলেন মরুর এক দেশে। পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন তাঁর দুজন নিকটাত্মীয়। যাঁদের একজন আমার বন্ধু, অন্যজন বন্ধুর বেয়াই। ব্যাংকার সাহেব ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক এলেন বাংলাদেশে। বিদেশের বাসায় রেখে এলেন এই দুই স্বজনকে। সম্পর্কে একে অন্যের তালতো ভাই। একজনের শখ হলো রান্না করবেন। পাকা রাঁধুনির মতো দৌড়াদৌড়ি করে আয়োজন করলেন সব উপকরণের। পরে অনেক সময় নিয়ে রান্না করে দুজন (বন্ধুসহ) খেতে বসলেন। খাওয়া শুরুর মিনিট দুই পর সম্পর্কিত তালতো ভাই আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, কেমন হলো আমার রান্না?’
বন্ধুর উত্তর, ‘তরকারিতে সবকিছু পরিমাপমতোই আছে। মসলাপাতিসহ প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসের ঘাটতি নেই, একটি জিনিস ছাড়া!’
শৌখিন রাঁধুনি অনেক কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী সেটা?’
আমার বন্ধুর স্বাভাবিক উত্তর, ‘মজা!’
একমাত্র মজা ছাড়া বাকি সব শতভাগ পারফেক্ট।
আজ থেকে কমবেশি আট বছর আগে পূর্বাপর না ভেবেই চলে এলাম ভালোবাসার শহর নিউইয়র্কে। প্রবাস জীবনের শুরু দেশের রাজধানী খ্যাত ওয়াশিংটন ডিসির পাশের রাজ্য মেরিল্যান্ডে। আপন ভাইবোনদের স্নেহবেষ্টিত হয়ে পাশাপাশি এক দঙ্গল স্বজনের অকৃত্রিম ভালোবাসায় দিন কাটত ফুরফুরে মেজাজে। তো সেই ফুরফুরে মেজাজ থেকে ক্রমেই মজার মতো উবে যেতে লাগল। সবই আছে, স্বজনেরাসহ গন্ডায় গন্ডায় আপনজন। প্রতি সপ্তাহে দাওয়াতে মজার মজার খানাপিনা। নাই শুধু আবোলতাবোল টাইপের জম্পেশ আড্ডার বৈচিত্র্যময় স্বাদ।
বন্ধুদের সবাই নিউইয়র্কে। ফোন করলে কত অনুষ্ঠান, স্থানীয় নির্বাচন, নয়তো বিশেষ দিনের মেলা আর পার্বণের খবর শুনি। ভালোবাসার শহরে কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলার খবর দেখি খবরের কাগজে। একসময় দেশে এসবের মধ্যেই দিন কাটাতাম। অথচ বিদেশে এসবের ধারেকাছে থাকতে পারছি না।
প্রতিদিন কাজ শেষে বাসায় এসে একই ঢঙের জনমানুষ। এক প্রিয়জনকে বললাম, ‘তোমাকে প্রতিদিন দেখে দেখে টায়ার্ড হয়ে গেছি। আর কিছু করতে না পারো একটি মুখোশ পরে তো আসতে পারো।’
বাকি সব ছিল ভীষণ রকমের ভালো। আয়পত্তর, চলাফেরা—সবকিছু অভিযোগহীন। শুধু নেই আড্ডার নানা সম্ভার নিয়ে কোনো ফেরিওয়ালার ফোন কল, চলে এসো বন্ধু। নামহীন, গন্ধহীন রাতের আদি চরিত্রের বদল হবে গানে আর কবিতার মাত্রা মেপে মেপে। না, কোনো ডাক আসে না। কেউ বলেও না, চলো আজ রাতের আকাশে তারার মিতালিতে গল্প করে সময় কাটাই।
বিরস বদনে বেদনায় সিক্ত হয়ে ভাবি আর কতকাল থাকতে হবে আড্ডাহীন শহরে। মিলে গেল সুযোগ। দেরি না করে শুরু করলাম বাক্সপ্যাটরা গোছানো। দুই মেয়ের ছোটজন বলল, ‘আরও একবার ভাবলে হয় না বাবা!’
বললাম, ‘না রে মা। ক্ষমা করে দিস এবারের মতো। ভোরের আলোর প্রথম প্রহরে চড়লাম ভাড়া করা ছয় আসনের গাড়িতে।’
নিউজার্সি টানপাইকে আসতেই চোখে পড়ে হাডসনের পাড়ে ম্যানহাটানের উঁচু-নিচু বহুতল অট্টালিকার সারিবদ্ধ কংক্রিটের মিছিল। ভালোবাসার নগরীর বুনো সুবাস নাকে এসে লাগল। বিকেলের নিউইয়র্ক দেখবার ক্রমাগত তাড়া আসতে লাগল। বারবার বন্ধুর ফোন। রেডি হয়ে থাকিস আমি আসছি।
উপলক্ষ জালালাবাদ সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন। পুরো এক টুকরো বাংলাদেশ। উৎসবের আমেজে ভালোবাসার মাখামাখিতে সবাই আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন। কেন্দ্রের পরিবেশ দেশের ভোটের আমেজকেও হার মানায়। শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রের এক পাশে হইচই চিৎকার। সব দেখছি আর ভাবছি, ডাঙায় আটকে পড়া জলের মাছ আজ জলের ছোঁয়া পেয়ে কতই না খুশি। হৃদয়ে অনুভব হচ্ছে শুদ্ধ তৃপ্তি, যাতে ছুঁয়ে আছে অসীম জলকেলির আনন্দধ্বনি। এ যেন জলের মাছের আবার জলেতে ফেরা।
চোখভর্তি রঙিন স্বপ্ন আর মাথাভর্তি আড্ডার রকমারি আইডিয়া নিয়ে ফেরা হলো। তবে বাঁচা আর চলার ফিকিরের পাঠ তো চুকাতেই হবে। সেই অংশটুকু কিছুটা কষ্টের, বিস্ময়েরও বটে। বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে বমাল ধরা। সালটি ২০০৯। ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকা নিউইয়র্কের চাকরির বাজার মন্দার কবলে। আর সেখানেই আনন্দের সব স্বাদ আর সব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও পেলাম না আসল মজা। সবই চলছে হিসাবমতো, শুধু আসল বিষয় মজার, মানে চাকরির কোনো খবর নেই।
তবে আশার কথা যে সে বিচ্ছেদ বেশি দিন স্থায়ী থাকেনি। শহর তার নিজ তাগিদেই এক আড্ডার বরপুত্রকে ডালভাতের সংস্থান করে দিয়ে বলল, এবার নিশ্চিন্তে নিউইয়র্কের ভালোবাসার সন্ধানে তোমার অভিজ্ঞতাকে সুরে বেঁধে আড্ডার কনসার্ট শুরু করো। সেই যে কবে শুরু হলো, তা আজও যেন থামছে না। তেমনি ভালোবাসার নিউইয়র্কে ডেকেই চলছে আর বলে যাচ্ছে, এই শহর তোর রে পাগলা, এই শহর তোর!
ভালোবাসার শহরে সবই আছে। আড্ডার নানা রঙের আসর। সুর ও সংগীতের শুদ্ধ অনুশীলনের চমৎকার পরিবেশ। বইয়ের দোকানে দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণ। বিদেশের মাটিতে বৃহত্তম বাংলা বইমেলার সফল আয়োজন। দেশ থেকে নামীদামি শিল্পীরা আসেন। তাঁদের নিয়ে মনোমুগ্ধকর সংগীতময় আনন্দসন্ধ্যা হয়। বিরাট হলে নিউইয়র্কাররা গান শুনে করতালিতে ফেটে পড়ে। সুরের আবেশে সুখের ঘোর নিয়ে বাড়ি ফেরে। তা সবই এই নিউইয়র্কে।
সাহিত্যের আড্ডায় কবিদের উপচে পড়া ভিড। কবিতাসন্ধ্যায় কবিদের সরব উপস্থিতি সাহিত্যের প্রতি নিউইয়র্কারদের ভালোবাসাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কবিরা প্রতিবছর সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে কিংবদন্তির কবিদের আটকে রাখে আপন মননে আর হৃদয়ে। শুধু কি সাহিত্য আর সংগীতচর্চা। পাশাপাশি দেশের নানা মত আর পথের রাজনৈতিক উত্তাপ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অনুভব হয়। অনেক নিউইয়র্কার মেতে থাকেন দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক নানা ঘটনার বিশ্লেষণমূলক আলোচনায়।
নিউইয়র্কের ভালোবাসা কিংবা ভালো লাগার একটি বড়ই জমজমাট এবং প্রচলিত বিষয় হলো আলোচনা। যার কোনো নির্দিষ্ট সীমা-পরিধি থাকে না। তবে সেই আলাপ-আলোচনার সিকিভাগেও পাওয়া যায় না বাস্তব কোনো সফলতার চিত্র। বিবিধ বিষয়ের একটি মূলধারার রাজনীতি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কতিপয় তথাকথিত মূলধারার রাজনীতিবিদের ধারণা শুধু স্থানীয় পত্রপত্রিকায় কিছু প্রাসঙ্গিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যসহ আমেরিকার হেভিওয়েট রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ওঠানো কিছু ছবি ছাপিয়ে দিলেই বুঝি হয়ে গেল মূলধারার রাজনীতিবিদের সঙ্গে সেতুবন্ধ।
আসলে তা কিন্তু নয়। নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার সঠিক প্রয়োগে এবং সবার অংশগ্রহণে কেবল মূলধারার রাজনীতির মূলকেন্দ্রে যাওয়া যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। তা কিন্তু করতে হবে সব অভিবাসী নিউইয়র্কারের সম্মিলিত প্রয়াসে। যেখানে সবাই সব ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা বা ঐতিহ্য অনুশীলনে মিলেমিশে অংশ নিতে আগ্রহী কিংবা নিয়েও থাকেন। কিন্তু দেশের তথা এই নিউইয়র্ক রাজ্যের কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যক্রমে সবার নিষ্ক্রিয়তার দায় কে নেবে? সমাজসচেতন বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ কর্মকর্তারা নাকি মূলধারার রাজনীতিবিদ? এ ব্যাপারে চলতি একটি বিষয়ে আলোকপাত করলে বোঝা যাবে মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ইস্যু কী পরিমাণ উপেক্ষিত।
৭ নভেম্বর নিউইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ মেয়র নির্বাচন। অথচ সিংহভাগ নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অভিবাসীর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই। নেই কোনো আলাপ-আলোচনা অথবা কোনো ধরনের কার্যক্রম। এমনকি তথাকথিত মূলধারার রাজনীতিবিদদের নেই কোনো দিকনির্দেশনা। অথচ আর এক বছর পর দেশে অনুষ্ঠেয় সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার প্রবাসী নিউইয়র্কবাসীর ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা; যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, প্রতিনিয়ত আমাদের সমগ্র সত্তায়, চিন্তায় দেশ জড়িয়ে আছে। কিন্তু এ দেশটিও আমাদের। আমাদের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবনার স্থানে আমাদের সরব উপস্থিতি থাকতেই হবে। তা না হলে আমরা আমাদের অধিকার প্রাপ্তিতে পিছিয়ে থাকতাম। তাই এই ভালোবাসার নিউইয়র্কে শুধু সাহিত্য সংগীত আর ঐতিহ্য নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে নিজ অধিকার আদায়ের মূল স্থানে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের লড়াইয়ে আরও সচেষ্ট হোন।
মনে রাখবেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা খুবই জরুরি। আপনার দাবি আদায় তখনই সম্ভব, যখন সকল স্তরের বাংলাদেশের অভিবাসীরা নিজেদের সংগঠিত করতে পারবে। দাবি আদায়ে শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপের একজন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হবে।
চারদিকের বন্ধ বাতায়ন খুলে দিন। তাহলেই দেখতে পাবেন হাডসনে চলছে নানান রাজনৈতিক খেলা। যার স্বরূপ ও স্বাদ আপনার-আমার জানা খুবই জরুরি।
আর না হলে গল্পের তরকারির মতো সব উপকরণ তথা তেল মসলা আর পানি পরিমাণমতো থাকলেও আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন আরও অনেক দিন।