কানাডার যেসব বই আমি নিজের জন্য কিনেছি সেগুলোর অধিকাংশই আগে লাইব্রেরি থেকে এনে পড়া, আধা-পড়া বা নাড়াচাড়া করা। প্রতি মাসে গড়ে দশ-পনেরোটি করে বই কেনা হয়ে যায় আমার। যেগুলো কিনেছি সেগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি নতুন, কেনা বইয়ের দোকান থেকে। নতুন বই মানেই একেকটি কমবেশি কুড়ি-পঁচিশ ডলার। তাই নতুন কেনাটা আমার মতো দরিদ্র পাঠকের জন্য অসম্ভব একটি বিষয়। তবে সদ্য প্রকাশিত বেশ কিছু নতুন বইও এসেছে। সেগুলো প্রকাশক ও লেখকদের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি। আর তাই স্বীকার করতেই হবে, কানাডার সাহিত্য নিয়ে গড়ে ওঠা আমার ব্যক্তিগত ছোট্ট লাইব্রেরিটির সিংহভাগই পুরোনো দোকান থেকে কেনা। গত চার বছরের বেশি সময় ধরে যে চার–পাঁচ শ বই টরন্টো পাবলিক থেকে এনেছি, সেগুলোর মধ্যে অনেক পছন্দের একটি হলো ‘রিডিং রাইটারস রিডিং’। লেখালেখি, পড়াপড়ি নিয়ে কানাডার খ্যাতিমান, কমখ্যাত বা খ্যাতিহীন লেখকদের লেখা ও ছবির বই এটি। সামনাসামনি দুই পৃষ্ঠার একটিতে ছোট্ট একটি লেখা, আরেকটিতে খুব কাছ থেকে তোলা লেখকের একটি ছবি। প্রায় আড়াই কেজি ওজনের এই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৬৮। আর আকার? ২৮.২ বাই ২৬.২ সেন্টিমিটার। বইটি যুগ্মভাবে প্রকাশ করেছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা প্রেস এবং জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটি ম্যাগনিস প্রেস। ২০০৬ সালে ছাপা হওয়া বইটির মূল্য ৫৪ ডলার।
বইটির সম্পাদক ড্যানিয়েল স্কাউব। ছবিগুলোও তাঁরই তোলা। ড্যানিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে কানাডীয় সাহিত্য পড়ান। শখের ফটোগ্রাফারও তিনি। লেখকদের যে ছবিগুলো তুলেছেন সেগুলো সাদাকালো। হোর্সে লুই বোর্হেসের সেই বিখ্যাত কথা ‘স্বর্গ বলতে আমি তেমন জায়গাকেই বুঝি যেখানে লাইব্রেরি থাকবে’ সেটাকে মাথায় রেখে ড্যানিয়েল বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য করেছিলেন ‘বইপড়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা’ নিয়ে তাঁর উদ্দিষ্ট লেখকেরা লিখবেন।
সকল অর্থেই মূল্যবান এই বইতে মোট এক শ চৌষট্টি জন লেখকের কথা আছে। প্রায় সবাই সম্পাদকের নির্দেশমতো লিখেছেন। বলেছেন বইপড়া নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। দু/একজনের বলার প্রসঙ্গ যে ভিন্নতর হয়নি তা কিন্তু নয়। আর তেমনটি করেছেন কানাডীয় সাহিত্যের দুই মহিরুহ মার্গারেট অ্যাটউড ও মাইকেল ওনডাডজি। তাঁরা কী করেছেন সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। নিউ ব্রাঞ্চউইকের বিস্ময় জাগানো তরুণ ঔপন্যাসিক মাইকেল ক্রামি কিন্তু লিখেছেন মজার এক কাব্যকথা—শিরোনাম ‘রিডিং ওনডাডজি’। শিরোনামেই বোঝা যাচ্ছে, এক মাইকেল কথা বলেছেন আরেক মাইকেলের উপন্যাস-পাঠ নিয়ে। কোন সে উপন্যাস? বিশ্বখ্যাত ‘ইন দ্য স্কিন অব অ্যা লায়ন’। কোনো কোনো লেখক কবিতায় তার ভাবনাটি বলেছেন। যেমন জন নিউলাভ। আবার কারও ক্ষেত্রে সেটি প্রশ্নোত্তরের মতোও হয়েছে। যেমন মেভিস গ্যালান্ট। কিন্তু সেসবে যাওয়ার আগে প্রথমে বলে নিতে চাই বইপড়া নিয়ে কানাডার লেখকদের অতীত অভিজ্ঞতা ও ভাবনার কথা।
এক শ চৌষট্টি জনের মধ্যে ইংরেজিভাষী লেখক এক শ আটত্রিশ। বাকি ছাব্বিশ জন ফরাসিভাষী। এই ছাব্বিশটি কিন্তু ফরাসি ভাষাতেই অন্তর্ভুক্ত। ড্যানিয়েল এই বিপুলসংখ্যক লেখকের সঙ্গে সংযোগ করেছেন, তাঁদের ছবি তুলেছেন। লেখা নিয়ে সম্পাদনা করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ছবি তোলার জন্য প্রত্যক্ষ সংযোগের কাজটি ড্যানিয়েল অধিকাংশই করেছেন সাহিত্য-আড্ডাগুলোতে।
বইতে কোন কোন লেখকের বইপড়া নিয়ে ভাবনা আছে? জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক, ইয়ান মার্টেল, আল পার্ডি, জন মেটকাফ, পি কে পেইজ, ডন কোলস, জন নিউলাভ, প্যাট্রিক লেইন, রয় মিকি, রবার্ট ক্রোয়েটস, ডেভিড অ্যাডাম রিচার্ডস, রবীন্দ্রনাথ মহারাজ, রুডি ওয়েব, অ্যান মাইকেলস, ফিলিস ওয়েব, ক্যাথরিন গোভিয়ার, রোজমেরি সালিভান, এলিজাবেথ হে, ফ্রন্সিস ইতানি, নিনো রিচি, ডগলাস গ্লোভার, ভেন বেগামুদ্রে, হেলেন হামফ্রে, গাই ভেন্ডারহেগে, অ্যালিস্টেইর ম্যাকলিয়ড, শ্যাম সালভেদুরাই, রু বরসন প্রমুখ। ফ্রাঙ্কোফোন সাহিত্যিকদের মধ্যে মেরি কেলয়ার ব্লেইজ বোধ করি একনামে চিনে ফেলার মতো নাম।
ধরা যাক জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের কথা। জর্জ হলেন কানাডার ভূতপূর্ব পার্লামেন্টারি পোয়েট লরিয়েট। বহু পুরস্কারে ভূষিত জর্জ কানাডার কালো লেখকদের মধ্যে শক্তিশালী একটি নাম। জর্জের লেখাটির শিরোনাম ‘ডু ইউ রিড মি’? জর্জ স্মরণ করেছেন তাঁর গ্রেড এইটের সময়কার ইংরেজি শিক্ষকের কথা। হ্যালিফ্যাক্সে থাকার কালে শৈশবে ওই শিক্ষক বলেছিলেন, ‘যা পড়তে ভালো লাগে, তাই পড়ো।’ ওই অমৃতবাণীটি যেন জর্জকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু পড়তে আগ্রহী করে তুলেছিল।
কানাডার আরেক লেখক, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ইয়ান মার্টেলও জর্জের মতো করে কৈশোরের স্মৃতিকে টেনে এনেছেন তাঁর লেখাতে। কীভাবে সেই শৈশব-কৈশোরে বইপড়া তাঁকে টানতো সেটি নিয়ে কথা বলেছেন ইয়ান। ‘লাইফ অব পাই’ খ্যাত এই লেখকের ভাষায়, ‘To read was to be somewhere else and something else. To read was to be sweetly alone, drinking in a solitude as refreshing as a mountain book. To read was to be an eye, that amazing “mind’s eye” that was so far, so acutely, while safely ensconced in the confines of my head.’
লক্ষ ডলার পুরস্কার পাওয়া উপন্যাস ‘ডু নট সে উই হ্যাভ নাথিং’-এর লেখক ম্যাডেলিন থিয়েন বলেছেন ভ্যাঙ্কুভারে তাঁদের স্কুলে লাইব্রেরি না থাকার কথা। জানিয়েছেন প্রতি শুক্রবার তাঁরা স্কুল থেকে লাইন দিয়ে যেতেন অন্য আরেকটি লাইব্রেরিতে। সেখানে কথাসাহিত্য সেকশনে দাঁড়িয়ে ম্যাডেলিনের যে অনুভূতি সেটি ছিল অনেক তীক্ষ্ণ। ওই তীক্ষ্ণতাই ম্যাডেলিনকে পরবর্তী জীবনে এত বড় লেখক বানিয়েছে।
সম্প্রতি প্রয়াত অগ্রগণ্য কবি ও ঔপন্যাসিক প্যাট্রিক লেইন বইপড়া নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বলতে গিয়ে কবিতার জন্মকথা দিয়ে শুরু করেছেন। কীভাবে কবিতার জন্ম হয় সেটি বলতে গিয়ে প্যাট বলেছেন তাঁর শৈশবের কথা যখন তাঁরা, বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তান, প্রতিযোগিতায় নামতেন গল্পবলা নিয়ে। তিনি জানিয়েছেন, সেরা গল্পটি বিবেচ্য হতো সেটির বিষয় দিয়ে নয়, বরং কীভাবে সেই গল্পটি বলা হতো তার ওপরে। ওই ‘কীভাবে’র মধ্যেই আসলে লুকিয়ে থাকে গল্পকথকের সাফল্য। সুখপাঠ্য ভাষায় প্যাটের এই তত্ত্বকথা যেকোনো পাঠককে অভিনব এক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম।
আলবার্টার লেখক রবার্ট ক্রোয়েটস তাঁর কৈশোরে স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছিলেন হেনরি জেমসের ‘দ্য টার্ন অব দ্য স্ক্রু’ এবং জোশেফ কনরাডের ‘দ্য নিগার অব দ্য নার্সিসাস’। ওই দুটি ব্রিটিশ উপন্যাস কী করে আলবার্টার প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলটির লাইব্রেরিতে গিয়েছিল সেটা নিয়ে রবার্টের যেমন বিস্ময়, তেমনি সে দুটি পাঠের পর, পরবর্তীকালে পুনর্পাঠের পর রবার্টের যে-বিষ্ময়াবিষ্টতা তাকেই জানিয়েছেন তিনি।
ব্যাপকভাবে নন্দিত সাহিত্যিক ডেভিড অ্যাডামস রিচার্ডস লিখেছেন, তিনি ছোটবেলায় বই পড়তে পছন্দ করতেন না। চৌদ্দ বছরের দিকে তিনি এক ক্রিসমাসে উপহার হিসেবে চার্লস ডিকেন্সের ‘অলিভার টুইস্ট’ পান। বইতে কোনো ছবি না থাকায় তিনি বিস্মিত হন এবং উপহারদাতার নির্বুদ্ধিতা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। প্রায় মাস তিনেক পর এক রাতে তিনি ঘরের মেঝেতে বইটি পরে থাকতে দেখেন। হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। এভাবে একাধারে তিন রাত পড়ে তিনি বইটি শেষ করেন। বইটি পড়তে পড়তে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি লেখক হবেন। আমাদের সৌভাগ্য ডেভিড লেখক হয়েছেন এবং কানাডায় লক্ষ ডলার মূল্যের সাহিত্য পুরস্কারটি তিনি লাভ করেছেন।
সারা বইটি জুড়েই যেন ছড়িয়ে আছে গভীর বোধের প্রসারণ। কখনো কখনো সেখানে ফুটে উঠেছে মুক্তোর ঝলক। সামান্য একটি বাক্য অসামান্য একটি আপ্তবাক্যে রূপ নিয়েছে। আর সে-সবের ভেতরেই চিত্রিত হয়েছে লেখকদের শৈশব-কৈশোরকাল। সে-কালে তাঁদের স্কুলের চিত্র, তাঁদের পাঠের ধরন। আর সে-সবের মধ্য দিয়ে যেন ফুটে উঠেছে পুরো কানাডার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
এবার আসি বইতে কানাডার অগ্রগণ্য দুই সাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড ও মাইকেল ওনডাডজির রচনা দুটি নিয়ে। মার্গারেট একটি কবিতা লিখেছেন। সাতাশ লাইনের। গভীর দ্যোতনা সৃষ্টিকারী সে-কবিতায় আমরা একজন নারীকে পাই যে কিনা আসলে মার্গারেটের আরেক সত্তা। কবি মার্গারেট হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন তিনি ও তাঁর ওই সত্তা মিলেই একজন ‘পূর্ণ’ যে কিনা লেখে, যে কিনা তার সকল বোধকে ভাষায় রূপান্তর করে। অন্যদিকে, মাইকেল ওনডাডজি বলেছেন একটি ছবির গল্প। ছবিটি তার বাবা ও মায়ের। লেখকের জন্মেরও আগে ১৯৩২ সালের ওটিই একমাত্র ছবি যেটিতে কালের স্রোতে অদ্যাবধি টিকে আছে পরবর্তীকালের বিশ্বখ্যাত এক লেখকের বাবা-মা। আমরা বুঝতে পারি, বইপড়াকে অন্যদের মতো করে এই দুই লেখক না দেখে সেখানে তাঁরা খুঁজছেন তাঁদের লেখকসত্তার অস্তিত্ব, অলিখিত এক গভীরতা।
এই বই হাতে নিয়ে একাধারে পড়ে শেষ করার নয়। ইচ্ছেমতো উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখা ও পড়ার বই। অথবা সূচি থেকে নিজের পছন্দের লেখকের পৃষ্ঠাটি পড়ার বই। আর তাই বছর দুয়েক আগে লাইব্রেরি থেকে এনে বইটি যখন নাড়াচাড়া করি, অনেক আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল। লাইব্রেরিতে বইটি ফিরিয়ে দেওয়ার সময় ছিল অনেক অতৃপ্তি। শেষে বছরখানেক আগে একদিন পুরোনো বইয়ের দোকানে ঝকঝকে এক কপি ‘রিডিং রাইটারস রিডিং’ পেয়ে আমার যে কী আনন্দ! ছয় ডলারে কিনে বইটাকে কোলের ওপর বসিয়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গাইতে গাইতে গাড়ি চালিয়ে বাসাতে ফিরেছি। ওই বই হাতে নিলে এখনো আমার মধ্যে আনন্দধারা বইতে শুরু করে। কারণ, এই বইয়ের প্রতিটি পাতা নতুন করে পড়া যায়। প্রিয় লেখকের ছবি নতুন করে দেখে নতুন বোধের সন্ধান করা যায়। এই বইতেই প্রবীণ সাহিত্যিক এলিসন গর্ডন বলেছেন, ‘আমি লেখক কারণ প্রথমত আমি পাঠক।’ মেভিস গ্যালান্টের মতো অসামান্য ছোটগল্পকার এই বইতেই লিখেছেন, ‘যে কখনো পড়েনি, সে কখনো লেখেনি।’
টরন্টোবাসী লেখক সুব্রত কুমার দাস রচিত ‘কানাডীয় সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ গ্রন্থটি গত বইমেলাতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ: subratakdas@yahoo.com