ফ্যাশনে ও প্রয়োজনে সানগ্লাস

নাফিসা নাঈর প্রমি
নাফিসা নাঈর প্রমি

আমেরিকার প্রকৃতিতে এখন চলছে শীতের দাপট। শীত তড়িঘড়ি এসে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বাইরের এই ঠান্ডা বাতাসের আক্রমণের শিকার হয় আমাদের চোখ। চোখ খুব সংবেদনশীল বলে রোদের তাপের মতো, ঠান্ডা বাতাসও সহজেই চোখকে আক্রান্ত করে। ঠান্ডার সংস্পর্শে এলে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। শীতে বরফ ঝরা দেশে যাদের বসবাস, আবহাওয়ার এই রূপটির সঙ্গে তারা পরিচিত। অনেকে ভাবেন, শীতের হালকা রোদে সানগ্লাস কী দরকার। সানগ্লাস পরার জন্য দিন, মাস বা ঋতুর হিসাবের প্রয়োজন নেই। সানগ্লাসকে কেবল ফ্যাশন ভাবলে ভুল হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজনও জুড়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তাই সব ঋতুতেই ফ্যাশনের এই অনুষঙ্গটির ব্যবহার চলে।

প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, সানগ্লাস গরমকালে বা প্রখর রোদে পরার জিনিস। ধারণাটা ভুল। সারা বছরই সানগ্লাস ব্যবহার করা খুব জরুরি। কারণ মেঘলা দিনেও সূর্যের ইউভি রশ্মি চোখের জন্য ক্ষতিকর। ধুলোবালি আর খোলা বাতাসে নানা রকম ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের শিকার হয় চোখ। তাই সূর্যের তাপ, ঠান্ডা বাতাস, ধুলাবালি থেকে রক্ষা, চোখের নিরাপত্তা ও ফ্যাশন সচেতনতার জন্য সানগ্লাসের বিকল্প নেই।
সানগ্লাস যতটা না ফ্যাশন; তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনে। বয়সের সঙ্গে বাড়ে চোখের নানা সমস্যাও; যার জন্য দায়ী সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি। মাইগ্রেন বা সাইনাসের সমস্যা, চোখের কর্নিয়া এবং রেটিনার জন্য ক্ষতিকর এই রশ্মি আটকাতে ও প্রতিহত করতে পারে সানগ্লাস। সরাসরি চোখে রোদ লাগাও ক্ষতিকর। চোখে রোদ পড়লে আমরা চোখ সংকুচিত করে তাকাই। ফলে চোখের চারপাশের নরম চামড়ায় দ্রুত ভাঁজ পড়ে। এ থেকে সুরক্ষা পেতেও সানগ্লাস বেশ উপকারী।

পোশাকের মতোই সারা বছর সানগ্লাসের ফ্যাশনেও নানা ট্রেন্ড বারবার ঘুরেফিরে আসে। তাই সানগ্লাসের কালেকশনেও বৈচিত্র্য আসে। ফ্যাশনেবল তরুণ-তরুণীরা ওজনে হালকা-পাতলা, গাঢ় রং, শেডের সানগ্লাসের প্রতিই বেশি আগ্রহী। ফ্যাশন ও প্রয়োজন—দুই ক্ষেত্রেই সানগ্লাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সানগ্লাস পরে আয়নায় নিজেকে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে মুখের গড়ন বুঝে সানগ্লাস কেনা উচিত। তাতে চোখের সুরক্ষার পাশাপাশি ফ্যাশনেও রুচিবোধ প্রকাশিত হবে। পরিচিতি পাওয়া যাবে স্টাইলিশ একজন মানুষ হিসেবেও।

ইদানীং সব বয়সী মানুষই সানগ্লাস ব্যবহার করছেন। সানগ্লাস এখন আর বাদামি কালোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন রং ও আকারের সানগ্লাস পাওয়া যায়। বেগুনি, নীল, সাদা, পানি, কমলা রঙের সানগ্লাসও বেশ প্রাধান্য পাচ্ছে। রঙের ভিন্নতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা রঙের বর্ডারযুক্ত সানগ্লাসও। নিত্য-নতুন সানগ্লাস ব্যবহার করে চেহারায় ও সাজে বৈচিত্র্য আনাও সহজ হয়েছে। তবে চেহারা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই গ্লাস, ডিজাইন বেছে নিতে পারলে নিজেকে সবার মধ্যে আলাদা করে ফুটিয়ে তোলা যায়।

নাফিসা নাঈর প্রমি

মুখের ধরন ও গায়ের রং অনুযায়ী সানগ্লাস বেছে নিতে হবে। এখন চড়া রংগুলো খুব ট্রেন্ডি হলেও যা তা রং বেছে নিলে হবে না। উজ্জ্বল গায়ের রঙের সঙ্গে স্বচ্ছ, নীল, সবুজ, বাদামি, গোলাপি ফ্রেম সবচেয়ে ভালো মানায়। কালো ত্বকে মেটালিক ফ্রেম, কালো, কফি, গাঢ় বা হালকা বাদামি রঙের সানগ্লাস মানিয়ে যায়।

হার্ট শেপ চেহারায় কপাল চওড়া ও চোয়াল সরু থাকে। ক্যাট আই, স্পোর্কি টাইপের সানগ্লাস বেশ মানিয়ে যায় এই চেহারায়। ডিম্বাকৃতি চেহারায় সব ধরনের সানগ্লাসই মানায়। ক্যাটস আই কিংবা অ্যাভিয়েটর ফ্রেমের সানগ্লাস গোল চেহারাকে কিছুটা হলেও লম্বাটে দেখাবে। আয়তাকার, কোণযুক্ত ফ্রেমের সানগ্লাসও তাদের জন্য ভালো।

বর্গাকৃতির চেহারায় মেটালিক ফ্রেম অথবা গ্লাসের নিচের অংশ রিম লেস সানগ্লাস মানিয়ে যায়। লম্বা মুখের সঙ্গে গোলাকৃতির সানগ্লাস ভালো যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সানগ্লাসের ফ্রেম যেন খুব ছোট না হয়। চতুর্ভুজাকৃতি চেহারায় ক্যাটস আই স্টাইল ভালো যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে সানগ্লাসে যেন চোখের কোল ঢেকে যায়; তাই সানগ্লাস একটু বড় হওয়াই ভালো।

মূলত চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়া থেকে সানগ্লাসগুলো আসে। মানসম্মত সানগ্লাস থাকে শোরুমে, বাকি সব যায় ফুটপাতে। চোখে সমস্যা থাকলে সাধারণ সানগ্লাস তেমন উপযোগী নয়। পাওয়ার চশমা ব্যবহারকারীদের জন্য সানগ্লাস কিছুটা দুর্লভ। সে ক্ষেত্রে চোখের পাওয়ার দিয়ে সানগ্লাস বানিয়ে নিতে হবে। প্রায় চশমার দোকানেই সানগ্লাসে পাওয়ার বসানোর ব্যবস্থা থাকে। তাই পাওয়ার দিয়ে সানগ্লাস বানাতে গেলে ফ্যাশন সচেতনতার সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে চোখের সুরক্ষা।

নিউইয়র্কের ফুটপাথের দোকানগুলোতে অনেক নন-ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাডা এইচঅ্যান্ডএম, ফর এভার টুয়েন্টি ওয়ান—এসব ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতেও বেশ সস্তা দামে হাল ফ্যাশনের সানগ্লাস পাওয়া যায়। পাঁচ ডলার ব্যয় করলেই এখান থেকে বৈচিত্র্যময়, রুচিসম্মত গোটা দুই সানগ্লাস রাফ ইউজের জন্য চট করে কেনা সম্ভব। ফ্যাশনের প্রয়োজনে যদি কিছুদিন অন্তর অন্তর সানগ্লাস বদলাতে চান, তবে নন-ব্র্যান্ডেড পণ্য ব্যবহার করাই ভালো। আছে ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য আলাদা সানগ্লাস; আবার কিছু সানগ্লাস ছেলেমেয়ে সবাই ব্যবহার করতে পারে।

ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস
ফুটপাত থেকে শুরু করে নামকরা স্টোর—সবখানেই সানগ্লাস পাওয়া গেলেও ব্র্যান্ডেড জিনিসের প্রতি সবারই বাড়তি আকর্ষণ থাকে। ব্র্যান্ডের দামি সানগ্লাস কেনার আগে সেটা অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা উচিত, দেখতে হবে সেটা মানাচ্ছে কি না। নয়তো পরে মন খারাপ হতে পারে।
ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস চাইলে অবশ্যই ব্র্যান্ডের দোকানে যেতে হবে। ব্র্যান্ডেড সানগ্লাসে দুই ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। গুণগত মান ভালো থাকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ফ্যাশনেবল হয়।

সুমিত আরমানি



কেমন সানগ্লাস পরা উচিত

ফ্যাশনেবল সানগ্লাস অতি বেগুনি রশ্মির পুরোটাই আটকাতে পারে না। সানগ্লাস কেনার আগে তাই এই ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। এমন সানগ্লাস কেনা প্রয়োজন যা অন্তত শতভাগ সূর্যের ইউভিএ এবং ইউভিবি রশ্মি থেকে চোখকে বাঁচাতে পারে। ইউভি ৪০০–এর লেবেলযুক্ত সানগ্লাস চোখকে সুরক্ষিত রাখে, সুতরাং কেনার সময় এটা দেখে নেওয়া খুবই জরুরি। পোলারাইজড লেন্সযুক্ত সানগ্লাস সূর্যের কড়া আলো থেকে তো বাঁচায়ই, তা ছাড়া এর সাহায্যে চারপাশে পরিষ্কার দেখাও যায়। পোলারাইজড লেন্স পানি, বরফ আর কাচ থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি কমাতে সাহায্য করে। এসব সানগ্লাস বেড়াতে গেলে বা ড্রাইভিংয়ের সময় খুবই কার্যকরী। আবার যারা বাইরে বেশির ভাগ সময় কাটান, তাদের জন্য র‌্যাপ অ্যারাউন্ড সানগ্লাস চোখকে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত রাখে।

চশমা, সানগ্লাস পরার পর চারদিক দেখে নিশ্চিত হতে হবে, কোনো ইমেজ-ডিসটিশন হচ্ছে না। যাদের স্কিনে অ্যালার্জির সম্ভাবনা থাকে, তারা স্টেইনলেস স্টিলের ফ্রেম পরতে পারেন।

প্রেসক্রিপশন সানগ্লাস
চোখে পাওয়ার চশমা পরলে রঙিন সানগ্লাস পরে ঘুর বেড়ানো কী সম্ভব? যারা পাওয়ার চশমা পরে থাকেন, আবার সানগ্লাসও পরতে চান তাদের মুশকিল আসান করবে প্রেসক্রিপশন সানগ্লাস। চোখের পাওয়ার অনুযায়ী, লেন্স থাকায় এই বিশেষ সানগ্লাস পরে আপনি পরিষ্কার দেখতেও পাবেন আর সূর্যের আলো থেকে চোখ সুরক্ষিতও থাকবে। বাড়তি পাওনা স্টাইলিশ লুক! যেকোনো বড় অপটিক্যাল স্টোরে পেয়ে যাবেন প্রেসক্রিপশন সানগ্লাস। তবে ভিন্নধর্মী কাঁচে তৈরি এই বিশেষ সানগ্লাসের দামও খানিকটা বেশি।

সানগ্লাস ব্যবহারের কিছু রীতিনীতি
কোনো ঘরে, অনুষ্ঠানে, মার্কেটে, ইনডোর গেইমসের স্টেডিয়ামে প্রবেশের আগে সানগ্লাসটি খুলে রাখা সৌজন্যবোধের বহিঃপ্রকাশ।
কখনোই সানগ্লাস চোখে রেখে কথা বলা উচিত না, এমনকি ছোট শিশুদের সঙ্গেও নয়। কারণ কথা বলার সময় মানুষ আই কন্টাক্ট পছন্দ করে।
অফিশিয়াল কাজে যেকোনো এক রঙের গ্লাস ও ফ্রেম ব্যবহার করা উচিত। কোথাও বেড়াতে বের হলে মৌসুমের সঙ্গে খাপ খায়, এমন বাহারি সানগ্লাস পরতে হবে।
একই সানগ্লাস সব সময় ব্যবহার না করে মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সানগ্লাসও পরিবর্তন করা উচিত। ঘন ঘন চুলে সানগ্লাস আটকে রাখা শুধু বেমানান দেখায় না, এটা রুচি সম্পর্কে অসচেতনতার পরিচায়ক।
সানগ্লাসটি যে হাজার টাকার হতে হবে—এমনটি নয়। সানগ্লাসের মুখ্য উদ্দেশ্য, চোখকে সুরক্ষা করা। এর জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে একটি সানগ্লাস কেনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মোটামুটি মূল্যের সানগ্লাস কেনা উচিত। কারণ, এতে করে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্য-নতুন কয়েক ধরনের সানগ্লাস কেনা সহজ।
সানগ্লাস চোখের সুরক্ষার পাশাপাশি ফ্যাশন-সচেতনতারও মাপকাঠি। এটা ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। আর তাই সানগ্লাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে তা ব্যক্তিত্বকে খর্ব না করে রুচিবোধকে আরও ফুটিয়ে তুলবে। সানগ্লাস হলো তারুণ্যের প্রতীক। সানগ্লাস ছাড়া এ যুগের ফ্যাশন যেমন অপূর্ণ, তেমনি সানগ্লাসের সঠিক ব্যবহার অজানা থাকাও রুচির অপূর্ণতা প্রকাশ করে। নিজেকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে ফ্যাশনেবল সানগ্লাসের সঙ্গে সঠিকভাবে এর ব্যবহার জানাও খুব প্রয়োজন।

কোথায় পাবেন, দাম কেমন

যারা দামি ব্র্যান্ডের সানগ্লাস কেনার কথা ভাবছেন, তারা চলতি সময়ের ফ্যাশনেবল ব্র্যান্ডের সানগ্লাসগুলো দেখতে পারেন নিউইয়র্কের নামকরা ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে—
গুচ্চি
গোল্ড ফ্রেমের অ্যাসিটেট সানগ্লাসটিতে রয়েছে ক্ল্যাসিক্যাল ছাপ। কিংবদন্তি জাপানি কারিগরদের হাতে তৈরি এই সানগ্লাসের দাম পড়বে ৬৭৫ ডলার।
প্রাদা
উজ্জলরঙা ফ্রেমের মেটাল ও অ্যাসিটেট সানগ্লাসটি কিনতে হলে খরচ হবে ৩৩০ ডলার।
বোত্তেগা ভেনেতা
ইতালিয়ান ব্র্যান্ড বোত্তেগা। এই সানগ্লাসে সত্তরের দশকের ক্ল্যাসিক ছাপ রয়েছে। দাম প্রায় ৪০০ ডলার।
অ্যাকনি স্টুডিওজ
অ্যাকনি স্টুডিওজের মেটাল ব্রাউন সানগ্লাসটির দাম ৩৬০ থেকে ২০০ ডলার।
সেন্ট লরেন্স
আইভরি রঙের ফরাসি ক্ল্যাসিক ৫১ সার্ফ সানগ্লাস। বিলাসী এই সানগ্লাসের দাম প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার।
রে-ব্যান
ক্ল্যাসিক ওয়েফেরারের দাম পড়বে ১৫০-৫০০ ডলার।
টম ফোর্ড
টম ফোর্ডের অ্যাভিয়েটর স্টাইল হর্ন সানগ্লাস তৈরি হয়েছে সোনা ও মহিষের শিং থেকে। নানা ভেরাইটির দাম ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৯৪০ ডলার।