প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'হরিবল' এক মাস

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

এক মাস ধরে একের পর এক মন্দ খবর পাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরবর্তী নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস বাকি। এই সময় প্রতিটি জাতীয় জনমত জরিপে তাঁকে টপকে এগিয়ে গেছেন ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন। এমনকি তাঁর জন্য নিরাপদ বিবেচিত অঙ্গরাজ্যেও বেশ জেঁকে বসেছেন বাইডেন। এই অবস্থায় একমাত্র প্রতিষেধক নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ফিরে যাওয়া। ট্রাম্প বরাবরই নির্বাচনী সভার উত্তাপ থেকে নিজের জন্য বাড়তি প্রাণশক্তি খুঁজে পেয়েছেন। সে জন্যই কোভিড-১৯-এর বিপদ জেনেও গতকাল শনিবার ওকলাহোমার টুলসাতে নির্বাচনী র‍্যালির আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকেও আশাহত হয়েছেন ট্রাম্প।

আশা করা হয়েছিল, সভাস্থল দর্শকে-সমর্থকে কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে। সেখানে মাত্র ১৯ হাজার মানুষের স্থান সংকুলান হয়, অথচ ১০ লাখ লোক টিকিটের আবেদন জানিয়ে রেখেছিল। ‘এমন সভা ওকলাহোমার মানুষ আগে কখনো দেখেনি’—ট্রাম্প আগাম আশাবাদ জানিয়ে রেখেছিলেন। যারা সভাস্থলে আসন পাবে না, তাদের জন্য বাইরের একটি উন্মুক্ত মঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছিল। কম করে হলেও ৪০ হাজার মানুষ তো সেখানে থাকবেই। মূল মঞ্চে ঢোকার আগে ট্রাম্প সেখানে ভক্তদের দর্শন দিয়ে যাবেন, এমন ব্যবস্থাই করা ছিল।

কিছুই হলো না। ১৯ হাজারের জায়গায় বড়জোর সাড়ে ছয় হাজার দর্শক উপস্থিত। বাইরের উন্মুক্ত মঞ্চে ৪০ হাজার তো নয়ই, শ–খানেক লোকও অপেক্ষা করে নেই। সরকারি উড়োজাহাজে খুব নিচে দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ট্রাম্প দেখলেন সব খাঁ খাঁ করছে। সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত মঞ্চ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেন তিনি।

এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের কারণে অনেকে মঞ্চে ঢুকতে পারেনি। একদিন আগে এক টুইটে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন—কেউ যদি বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে, তাদের দেখে নেওয়া হবে। তারপরও অনুগত সমর্থকেরা কেন এল না, তার ব্যাখ্যায় জানানো হলো, ‘সব দোষ মিডিয়ার। তারা সবাইকে কোভিড-১৯–এর বিপদ নিয়ে অনবরত ভয় দেখিয়ে চলেছে।’

যেমন ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, টুলসার র‍্যালি থেকে তাঁর ঝিমিয়ে পড়া নির্বাচনী ক্যাম্পেইন নতুন শক্তি নিয়ে শুরু করার যে পরিকল্পনা ট্রাম্প করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো সবাই এই নিয়ে ঠাট্টা করছে। অতি-দক্ষিণপন্থী হিসেবে পরিচিত অনলাইন পত্রিকা ‘ড্রাজ রিপোর্ট’ হুল ফুটিয়ে লিখেছে, ‘মাগা ছাড়া মেগা’। মাগা কথার অর্থ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’; ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগান। একই সভার বিবরণে নিউইয়র্কার পত্রিকার শিরোনাম, ‘টুলসার শূন্য মঞ্চে ট্রাম্প।’ এই পত্রিকা ঠাট্টা করে লিখেছে, ট্রাম্প তাঁর পরবর্তী সভা হোয়াইট হাউসের ‘বাংকার’-এ করবেন বলে ঠিক করেছেন।

যে ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’র ওপর ট্রাম্প ভরসা করেছিলেন, তারা এবার ঘরে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক বিশ্লেষক। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে তাঁর দুর্বল নেতৃত্ব এর একটি কারণ। অন্য কারণ দেশজুড়ে আফ্রিকান-আমেরিকানদের দাবির সপক্ষ পুলিশবিরোধী বিক্ষোভের মুখে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে তাঁর ব্যর্থতা। আমেরিকার ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে বর্ণবাদ এ দেশের একটি প্রধান সমস্যা। সে কথা স্বীকারের বদলে ট্রাম্প জোর দিচ্ছেন ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’-এর ওপর। তিনি আশা করছেন, পুরোনো বর্ণবাদী তাস ব্যবহার করে তিনি ফের ক্ষমতায় ফিরবেন। বাস্তবে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প যে পিছিয়ে পড়ছেন, তার আরেক প্রমাণ মিলেছে টুলসার র‍্যালির পরের দিনই। ট্রাম্প ও বাইডেনের নির্বাচনী প্রচার দল তাদের সর্বশেষ সংগৃহীত তহবিলের যে মাসিক হিসাব দিয়েছে, তাতেও বাইডেনের পেছনে ট্রাম্প। মে মাসে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান নির্বাচনী কমিটির সংগৃহীত চাঁদার পরিমাণ ৭৪ মিলিয়ন ডলার। একই সময় বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক ক্যাম্পেইন সংগ্রহ করেছে প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার। তবে মোট সংগৃহীত তহবিলের হিসাবে ট্রাম্প এখনো বিস্তর এগিয়ে।

স্বাভাবিকভাবেই বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক পার্টি আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে আশান্বিত। তারা কেবল হোয়াইট হাউস নয়, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। অভিজ্ঞ নির্বাচনী বিশ্লেষকেরা অবশ্য তাঁদের অতিরিক্ত আশাবাদের বিরুদ্ধে সাবধান করে দিয়েছেন। ২০১৬ সালেও ট্রাম্পকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, তার ফল হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটন।

নির্বাচনের আগে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। করোনাভাইরাসের একটি কার্যকর টিকা বেরিয়ে যেতে পারে। এই দুই ঘটনা ট্রাম্পের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ পুরোপুরি বদলে দেবে—সে কথা মাথায় রেখে বাইডেনের অন্যতম উপদেষ্টা সিনেটর ক্রিস কুনস আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ডেমোক্র্যাটদের অতিরিক্ত আশাবাদ। নির্বাচনী জরিপ দেখে অনেক ডেমোক্র্যাট ভাবছেন ট্রাম্পকে পরাস্ত করা খুব সহজ হবে। ২০১৬ সালেও তাঁরা এমনটিই ভেবেছিলেন। ফলে অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনই দেখেননি।

আরেক ডেমোক্র্যাট নেতা সিনেটর ডিক ডারবান বলেছেন, ‘জনমত জরিপ দেখে উত্তেজিত হওয়া বোকামি। ২০১৬ সালে এই বোকামিই আমরা করেছিলাম।’

এই সতর্কতা সত্ত্বেও ডেমোক্র্যাটরা আশায় দিন গুনছেন। নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত সিনেটর ক্রিস্টিন জিলিব্রান্ড বলেছেন, ‘এবার অবস্থা ভিন্ন। আমেরিকার সামনে এখন একাধিক সংকট। এই অবস্থায় একজন পরীক্ষিত নেতার অপেক্ষায় দেশ। বাইডেন হলেন ঠিক সেই রকম একজন নেতা।’