আমেরিকায় আগেও দুই বার এসেছেন খিলখিল কাজী। তবে নিউইয়র্কে এবারই প্রথম। এবার এসেছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন শতদল আয়োজিত ‘অনুভবে নজরুল’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে আয়োজিত নজরুল কনভেনশনে অংশ নিয়ে তারপর নিউইয়র্কে। প্রবাসে জাতীয় কবিকে নিয়ে এত সব আয়োজন মুগ্ধ করেছে তাঁকে। কাজী নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী সব্যসাচীর মেয়ে খিলখিল কাজী। দাদুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই হোক, নজরুল চর্চা মুগ্ধ করে তাঁকে।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খিলখিল কাজী জানালেন সেই ভালো লাগার কথা। বললেন, ‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। প্রবাসী বাঙালিরা এত দূরে এসে, এত ব্যস্ততার মধ্যেও যে কবিকে ভুলে যায়নি, এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
৭ অক্টোবর পিএস সিক্সটি নাইন স্কুলে আয়োজিত ‘অনুভবে নজরুল’ অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক কবির কিরণ বলেন, ‘আমরা এই অনুষ্ঠানে চেষ্টা করব নজরুলকে সম্পূর্ণ তুলে ধরতে। গান, কবিতায়, গিটারের মূর্ছনায়, সেমিনারে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় থাকবে নজরুলের জীবনের নানা দিক।’
অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু শুনে খিলখিল কাজী বলেন, নজরুল তো শুধু কোনো নির্দিষ্ট কালে সীমিত নন, অনন্তকাল ধরে থাকবেন তিনি বাঙালির হৃদয়ে। প্রবাসে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে তুলে ধরা খুব জরুরি। কারণ বর্তমান হানাহানি-সংঘাতের যুগে নজরুল চর্চা খুব জরুরি। তিনি প্রথম বলেছেন, গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। তাঁর কবিতায় মানুষের মহত্ত্বকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে যখন কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে চলে আসেন বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী ও তাঁর পরিবার। ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ পরিবারসহ কলকাতায় থেকে যান। ১৯৬২ সালে কলকাতায় জন্ম হলেও দাদু আর বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন খিলখিল কাজী। বর্তমানে ঢাকায় আছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নজরুল চর্চার সুবাদে খিলখিল কাজীর অভিমত হলো, ‘বিশ্বময় নজরুল চর্চা আগের চেয়ে বেড়েছে। অনেক দেশে তাঁকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। তবে কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র রচনাবলীর আরও বেশি অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। শুধু ইংরেজি ভাষাতেই নয়, স্প্যানিশ-ফরাসি-জার্মানিসহ সব ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার কবিকে।’
নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় নজরুল চর্চার সংগঠনগুলি কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ অনুষ্ঠান করে। খিলখিল কাজী মনে করেন, ‘কবিকে নিয়ে সারা বছর কাজ হওয়া উচিত। একজন মানুষ মাত্র ২৩ বছর লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, এর মধ্যে তিনি সাড়ে চার হাজার গান রচনা করে গেছেন। এটা আমার কাছে একটা বিশাল ব্যাপার। তবে ঢাকায় নজরুল ইনস্টিটিউট নিয়মিত কাজ করছে কবিকে নিয়ে। আমি সেখানে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। আমরা কবির ১৮০০ গানের স্বরলিপি তৈরি করেছি। আর সর্বমোট তিন হাজার ১৬টি গানের একটি সংকলন করা হয়েছে। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতি বছর যে সম্মেলন করে, সেখানে ৬৪ জেলার প্রতিনিধিত্ব থাকে।’
২০১৩ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রদত্ত ‘নজরুল পদক’ পান খিলখিল কাজী। ওই বছর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের চুরুলিয়াতে অবস্থিত নজরুল একাডেমিও তাঁকে পদক দেয়। কবির পৌত্রী নজরুলের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে চলেছেন অবিরাম। ঢাকা ত্যাগের কয়েক দিন আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও নিয়াজ জামানের সঙ্গে বসেছিলেন, কবির উপন্যাসগুলো অনুবাদের ব্যাপারে।
এখন নজরুলকে নিয়ে নানা রকম ব্যবসা হলেও বাস্তবে কবি সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে গেছেন বলে মন্তব্য করেন খিলখিল কাজী। বলেন, ‘আমার দাদু পুরোটা জীবন খুব কষ্ট করেছেন। প্রকাশকেরা ঠিকমতো বইয়ের রয়েলিটি দেননি। গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে ঠকিয়েছে। শেষ জীবনে এসে তো বাক্শক্তি হারালেন। মনে আছে আমরা তখন ছোট, মা উমা কাজী দাদুর সব যত্নআত্তি করতেন। আর কেউ কিছু করেনি। দাদুর যখন চুল কেটে দেওয়া হতো, আমরা ভাইবোনরা ওনার মাথা ধরে রাখতাম। মা ওনার নখ কেটে দিতেন। একেবারে শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন শেষ বয়সে।’
কাজী নজরুল ইসলামের মতো এভাবে মানুষের জয়গান, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বাংলা সাহিত্যে কেউ করেননি বলে অভিমত খিলখিল কাজীর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে সবচেয়ে উচ্চারিত নামটি হলো কাজী নজরুল। এ জন্য অনেকে কবিকে ঈর্ষা করতেন বলে জানান খিলখিল কাজী। তিনি বলেন, ‘রবি ঠাকুর আমার দাদুকে খুব স্নেহ করতেন। যেটা তাঁর আশপাশের অনেক কবি-লেখক সহ্য করতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার পরে তাঁরা প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করতেন দাদুর সঙ্গে। ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিশক্তি হারালেও সঠিক সময়ে তাঁর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। ১০ বছর পরে ১৯৫২ সালে তাঁকে ভিয়েনায় পাঠানো হয়। এ সব ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। ব্রিটিশদের রাগ ছিল দাদুর ওপর। তদুপরি অন্য কবিরাও তাঁকে ঈর্ষা করতেন।’
খিলখিল কাজী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বরাবরই উৎসাহ জোগাতেন দাদুকে। ২২ বছর বয়সে যখন কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটা পড়ে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রশংসাপত্র দেন। ১৯২৩ সালে দাদু যখন জেলখানায় অনশন শুরু করলেন, রবীন্দ্রনাথই তাঁকে নিবৃত্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের বাংলা সাহিত্যের অনেক দাবি আছে তোমার কাছে। দাদু মুক্তি পাওয়ার পরে কবিগুরু বলেন, জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। অন্নদাশংকর রায়ও দাদুর মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কেষ্টপুরের ভিআইপি রোডের কাছে একটা জমি দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামকে। যেহেতু কবি তখন কথা বলতে পারতেন না, পরে সেটা বেহাত হয়ে যায়। বাম দলের শাসনের সময় সেই জমি আর উদ্ধার করা যায়নি। চার দশক পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সেই জমি ফিরিয়ে দিয়েছে।’
৭ অক্টোবর শতদলের অনুষ্ঠানে খিলখিল কাজী দাদুর লেখা গান গাইবেন। তাঁকে নিয়ে কথাও বলবেন। ঢাকা থেকে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছেন নজরুল সংগীত শিল্পী সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বাফা, নজরুল একাডেমিসহ বহু সংগঠনে দুই যুগের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন। আমেরিকায় তাঁর এটি প্রথম আগমন।