আমরা ঈশ্বর দেখি না। তাঁকে জানি নানা মহিমায়। স্পেশাল নিড চাইল্ড বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মায়েরা একেকজন শুধু মা-ই নন, তাঁরা যেন সেই মহিমা, যা দিয়ে আমরা ঈশ্বরকে বুঝতে শিখি। স্পেশাল নিড চাইল্ড নিয়ে কেমন আছেন উত্তর আমেরিকার মা-বাবারা?
সন্তানের জন্মের পরই কোনো মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেন না। পারার কথাও নয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো শিশুর ব্যতিক্রম ভাবভঙ্গি ও আচরণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। যখন সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তখন তাঁরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক যদি কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের মতো স্থায়ী নিউরোলজিক্যাল বা সাইকোলজিক্যাল সমস্যা চিহ্নিত করেন, তখন সংশ্লিষ্ট শিশুর মা-বাবার দিশেহারা হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অসহায়ত্বসহ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয় না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু এ অবস্থা তাঁদের কাটিয়ে উঠতে হয়। কাটিয়ে উঠতে না পারলেই শিশু সন্তান ও মা-বাবা উভয়ের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আনোয়ারা আনা আমানের দশ বছর বয়সী ছেলে শায়ান আমান। লং আইল্যান্ডের একটি স্পেশাল নিডস স্কুলে ফোর্থ গ্রেডের ছাত্র। আনা জানান, ওর বয়স যখন দু বছর, তখন ওর মাইল্ড টু মডারেট অটিজম ধরা পড়ে। তার বয়স যখন ১৮ মাস, তখন সে প্রায় পাঁচ শ শব্দ উচ্চারণ করত। কিন্তু এরপর সে ধীরে ধীরে শব্দগুলো হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থা তাদের কাছে সহনীয় ছিল না। শায়ানের মা আনা বলেন, প্রথম যখন ছেলের ডায়াগনোসিস রিপোর্ট হাতে পান, তখন তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
আনা বলেন, ‘যেহেতু সে ছিল আমার প্রথম সন্তান, আমাদের জন্য মেনে নেওয়া তখন খুব কঠিন ছিল। মনে হয়েছে একটি ঝড় এসে আমাদের জীবনকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। কিন্তু একটি পর্যায়ে আমাদের মেনে নিতেই হলো। কারণ, সন্তানকে যে করেই হোক সঠিকভাবে লালনপালন করতে হবে। আমরা অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম, কীভাবে সন্তানকে সমাজ ও সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো করে গড়ে তোলা সম্ভব। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সবকিছু এলোমেলো লাগে। মা-বাবার অবর্তমানে সে কীভাবে তার জীবন কাটাবে। মা হিসেবে আমার নিজের মধ্যে কী পরিবর্তন আনতে হবে, আমি সেগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলাম।’
আনা নিজেকে ব্যস্ত করে তোলেন, কীভাবে ছেলেকে উন্নত জীবনে ধাবিত করা যায় সেই লক্ষ্যে। যত দিন যায়, আনার ধারণাও পাল্টাতে থাকে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন গাঢ় হতে থাকে। অটিজম সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভেতর থেকে ভয় কেটে যেতে শুরু করে। কিন্তু আনার পরিবারকে দেড়-দু বছর অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
সন্তান শায়ান নিউইয়র্কের স্পেশাল নিড স্কুলে যায়, সেখানে থেরাপিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় সহায়তা করেন। শায়ানের বয়স যখন চার বছর, তখন তার নিউরো চিকিৎসকেরা তার সমস্যাকে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) হিসেবে শনাক্ত করেন। এ সমস্যার কারণে শায়ান কোনো বিষয়ে সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয় না। হঠাৎ বেশি সক্রিয় বা তৎপর হয়ে ওঠে এবং ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা চিন্তা না করেই কোনো কিছু করে বসে। অনেক সময় সে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
শায়ানের মা আয়ান বলেন, ‘সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাতে আমার উপলব্ধি হয়েছে—এ ধরনের শিশুকে পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে আসার জন্য পুরোপুরি স্কুলের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। পরিবারের সদস্যদেরও স্পেশাল নিড চাইল্ডের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ এবং তার প্রতিটি কাজ ও চাহিদার প্রতি সাড়া দিতে হবে সমানতালে।’
শায়ানের বয়স এখন ১০ বছর। এখনই সে সামাজিক, পারিবারিক ভাব বিনিময় করতে পারে। এসব সম্ভব হয়েছে স্কুল ও বাড়িতে সমানভাবে থেরাপি পাওয়ার কারণে। এসবের পাশাপাশি স্পেশাল নিড শিশুকে এই সমাজে পৃথকভাবে দেখা হবে না, অন্য সবার মতোই তাকে দেখা হবে, এটাই শায়ানের পরিবারের প্রত্যাশা। স্পেশাল নিড শিশু ও তাদের মা-বাবাকে কেউ যাতে করুণার দৃষ্টিতে না দেখে। অন্যান্য শিশু যে সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার পায়, স্পেশাল নিড শিশুও তা সমভাবে যেন পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে—এটাই শায়ানের পরিবারের দাবি।
আমেরিকায় এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত ও বিশেষ করে নিউইয়র্কে তাদের সেবার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা অন্য কোনো অঙ্গরাজ্যে নেই। এ কারণে তিনি আমেরিকায় জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও বিয়ের পর বাংলাদেশে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে দেশে চলে যান। কিন্তু আমেরিকায় শায়ানের অটিজম শনাক্তের পর তিনি আমেরিকায় চলে আসেন সন্তানের চিকিৎসা ও শিক্ষা সুবিধার কথা বিবেচনা করে। উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি অনেক পরিবারে এ ধরনের শিশু রয়েছে। তারা অপেক্ষাকৃত ভালো চিকিৎসা সেবা ও তাদের উপযোগী শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশে এমন কোনো সুযোগ নেই বা যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
শায়ানের পরিবার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সেবার জন্য বাংলাদেশে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন। যেখানে প্রতিটি স্পেশাল নিড চাইল্ডের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন এবং সমাধানগুলোও তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বের হয়ে আসবে। প্রতিটি মা-বাবা চান, তাঁদের সন্তান শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যেমনই হোক না কেন, তারা সক্ষম হয়ে উঠুক ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। এ জন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে চিকিৎসা ও থেরাপির যে উন্নততর পরিবর্তন আসছে, তার বিষয়ে। আয়ান মনে করেন, স্পেশাল নিড শিশুদের মা-বাবাকে প্রো-অ্যাকটিভ বা অতি-সচেতন থাকতে হবে সব সময়। শায়ানের মা আরও বলেন, ‘আমার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান আছে বলে আমি নিজেকে আশীর্বাদধন্য বলে মনে করি।’
শায়ান অত্যন্ত মেধাবী। ফোর্থ গ্রেডের ছাত্র হলেও তার রিডিং স্কিল সিক্সথ গ্রেডের শিক্ষার্থীর মতো। এ ছাড়া সে গানের প্রতি বেশ আগ্রহী এবং ইতিমধ্যে ইংরেজি গানের পাশাপাশি নজরুলগীতিও গাইতে পারে। ভালো ছবি আঁকে ও অভিনয় করে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ ও নিউইয়র্কে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। শায়ান অনর্গল বাংলা বলতে না পারলেও অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল ও লোকসংগীত গাইতে পারে। সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে নজরুলগীতি পরিবেশন করে সে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছে। তিন বছর বয়স থেকে সে মঞ্চাভিনয় করে। সে ভবিষ্যতে অভিনয়শিল্পী হতে চায়। সে চায় ভালো সংগীতশিল্পী হতে এবং বড় হয়ে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে। এরই মধ্যে সে ডিজনি স্টুডিওতে ডেমো প্রোগ্রামে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছে। শতাধিক দেশের ৩০০ জন শিশুর প্রতিভা যাচাইয়ের প্রতিযোগিতায় বিচারকমণ্ডলী তাকে অন্যদের সঙ্গে নির্বাচিত করেছে।