যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দক্ষিণে ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট একটি শহর প্যারিস। ২ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১৩ সন্তান নিয়ে এখানে থাকেন টারপিন দম্পতি। সাধারণ আর দশটি পরিবারের মতো নয় তাঁদের গল্প। বছরের পর বছর সন্তানদের ওপর তাঁরা এমন অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছেন যে তাঁদের বাড়িটির এখন নামই হয়ে গেছে ‘হাউস অব হরর’ বা ‘আতঙ্কের বাড়ি’!
মধ্যবিত্ত পরিবারটির কর্তা ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড টারপিন মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর চুক্তিভিত্তিক সংস্থা লকহিড মার্টিনের প্রকৌশলী। গৃহবধূ লুইসের সঙ্গে পরামর্শ করে সন্তানদের ‘মানুষ’ করার অদ্ভুত কিছু পন্থা আবিষ্কার করেন তাঁরা। পুলিশ যখন তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে শিশুদের উদ্ধার করে, তখন বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে ছিল মানব বর্জ্যের উৎকট গন্ধ। ১৩টি শিশুই গুরুতরভাবে অপুষ্টিতে ভুগছিল। ২২ বছরের একটি ছেলে বিছানায় শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল, দুটি মেয়েকে শিকলমুক্ত করা হয় তার কিছুক্ষণ আগে।
বাচ্চাদের বছরে একবারের বেশি গোসল করার অনুমতি ছিল না। টয়লেটে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। জীবনে কখনো দন্ত্যচিকিৎসকের চেহারাও তারা দেখেনি। না খেয়ে থাকতে থাকতে বড় কয়েক ভাইবোনের শারীরিক বৃদ্ধি এমনভাবে থেমে গেছে যে শুরুতে তাদেরও বাচ্চা মনে করেই ভুল করেছিল পুলিশ। সম্প্রতি ৯১১ নম্বরে ফোন করে একটি মেয়ে পুলিশের কাছে তাদের বেড়ে ওঠার যে লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে, তাতে গা শিউরে উঠবে যে কারও।
১৭ বছরের মেয়েটি জানে না তার বাড়ির ঠিকানা। দিন–তারিখের হিসাব কিংবা চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। জরুরি অপারেটরকে সে জানায়, ‘আমার তিন ভাইবোনকে এখনো বিছানায় চেইন দিয়ে আটকে রেখেছে। মাঝেমধ্যে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘর এতটাই নোংরা যে আমি নিশ্বাস নিতে পারি না।’ সারা বছর ঘরে বন্দী থাকলেও কদাচিৎ হ্যালোউইন বা পারিবারিক সফরে ডিজনিল্যান্ড কিংবা লাস ভেগাসে গেছে তারা।
সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে শিশুদের কারও নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে প্রত্যেকের নামের আদ্যক্ষর জ বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে টারপিন দম্পতির ১৭ বছর বয়সী কন্যা নোংরা ওই ঘর থেকে পালিয়ে যায়। তার বয়ান শুনে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে হানা দিয়ে টারপিন দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৩ সন্তানের মধ্যে ১২ জনকেই নিপীড়ন করার দায় স্বীকার করেন মা–বাবা। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় তাঁদের দুই বছর বয়সী সন্তান। গতকাল শুক্রবার আদালতে তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ২৫ বছর পর প্যারোল মঞ্জুর না হলে বাকি জীবন চৌদ্দ শিকের ভেতর দিন কাটাতে হবে তাঁদের।
ডেভিড-লুইস দম্পতির শিশুরা আদালতে জানায়, এত অত্যাচারের পরেও তারা এখনো তাদের মা–বাবাকে ভালোবাসে। সন্তানদের এই কথা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি মা–বাবা। শেষবারের মতো সন্তানদের একবার জড়িয়ে ধরতে চান তাঁরা। এক সন্তান বলে, ‘আমি মা–বাবাকে খুবই ভালোবাসি। তারা যেভাবে আমাদের বড় করেছে, তাকে হয়তো খুব ভালো বলা যাবে না। তবে তাদের জন্যই আজকের আমি হতে পারায় তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’
তবে একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করেনি সন্তানদের সবাই। অন্য এক সন্তানের বিবৃতিতে উঠে এসেছে, ‘কীসের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে, তা বলে বোঝানোর ভাষা আমার নেই। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে আমার। মনে হয়, ভাইবোনদের কেউ কি মার খাচ্ছে? কাউকে কি শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে? অতীতের সে স্মৃতি আমরা এখনো ভুলতে পারিনি।’ নিজেদের যোদ্ধা বানানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলার ইচ্ছা পোষণ করে তারা।
সন্তানদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কোনো মা–বাবা করতে পারেন, ইতিহাসে তার নজির পাওয়া দুষ্কর। কেন করেছেন তাঁরা এই কাজ? এই প্রশ্নের জবাবে বাবা ডেভিড জানান, ‘আমার গৃহশিক্ষা আর নিয়মানুবর্তিতার পেছনে ভালো উদ্দেশ্য ছিল। আমি কখনো বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি করতে চাইনি। আমি ওদের ভীষণ ভালোবাসি আর আমার বিশ্বাস ওরাও আমাকে ভালোবাসে।’
আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য ‘সত্যিই দুঃখিত’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন লুইস। একদিন সন্তানদের জড়িয়ে ধরে মন থেকে দুঃখ প্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তিনি।
আদালত অবশ্য এই দম্পতিকে ‘স্বার্থপর, নিষ্ঠুর ও অমানবিক’ বলে ভর্ৎসনা করেন। বিচারপতি বার্নার্ড স্কয়ার্টজ বলেন, ‘নিজের হাতে দুনিয়ায় আনা সন্তানদের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করে মানবতা লঙ্ঘন করেছেন আপনারা। কৃতকর্মের দায় স্বীকার করায় আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলেও এঁদের যে শাস্তিই দেওয়া হোক না কেন, তা কমই হবে। হাউস অব হররে বাচ্চারা যে বীভৎস দিন কাটিয়েছে, তার জন্য বাকি জীবন ভুগতে হবে তাদের।’