কোনো প্রমাণ ছাড়াই ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি কারচুপির অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রের ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকার করে যাচ্ছে। অভিযোগ নিয়ে রাজ্য পর্যায়ের আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ব্যর্থ হলেও মত বদলাচ্ছে না। ক্ষমতা হস্তান্তরে জো বাইডেনের প্রস্তুতি কমিটির সঙ্গেও কোনো রকম সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে চলেছেন। এর ফলে একদিকে মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরে নাগরিক বিভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুখে ‘না’ বললেও শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান নেতারা ব্যক্তিগতভাবে কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক নেতাদের কাছে স্বীকার করেছেন, নির্বাচনের ফল পরিবর্তনের মতো যথেষ্ট প্রমাণ তাঁদের হাতে নেই। তা সত্ত্বেও তাঁরা ট্রাম্পের কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন শুধু তাঁকে (ট্রাম্প) শান্ত করার জন্য। ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এক রিপাবলিকান নেতা যুক্তি দেখিয়েছেন, ট্রাম্পের মেজাজ ঠান্ডা করতে যদি কিছু সময়ের জন্য তাঁর কথায় সায় দিতে হয়, তাতে এমন কী ক্ষতি। এই সপ্তাহান্তে ট্রাম্প গলফ খেলতে গিয়েছিলেন, তা থেকেই প্রমাণ হয় তিনি জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ ঠেকাতে ষড়যন্ত্র পাকাতে সময় কাটাচ্ছেন না।
মার্কিন সরকারের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি হিসেবে পরবর্তী প্রশাসনকে সব সহযোগিতা প্রদানের কথা। এ জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার আলাদাভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সে তহবিল অবমুক্ত করতে সম্মত হয়নি। গভর্নমেন্ট সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান বাইডেন জয়লাভ করেছেন, সে কথা মানতে রাজি নন। ফলে শুধু তহবিল নয়, সরকারি ভবন ও কম্পিউটার ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বাইডেনের সহকর্মীরা।
এ কাজে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। আগের সব রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে তিনি বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর এই নির্দেশের প্রতিবাদে নির্বাচনী অপরাধ তদন্ত শাখার প্রধান রিচার্ড পিলজার পদত্যাগ করেছেন। কোনো বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর নির্দেশনায় তেমন কোনো প্রমাণ দাখিল করেননি। কোনো অনিয়ম হলে শুধু ভোট গণনা প্রত্যয়িত হওয়ার পরেই বিচার বিভাগ সে প্রশ্নে তদন্ত করে থাকে। সে নিয়ম অগ্রাহ্য করে ট্রাম্পকে খুশি করতেই উইলিয়াম বার এমন রীতিবিরুদ্ধ নির্দেশ দিয়েছেন বলে ভাবা হচ্ছে।
ট্রাম্পকে খুশি করতেই যে নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করা হচ্ছে, মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বাইডেন নিজেও সে কথা বলেন। এ পর্যন্ত মাত্র চারজন রিপাবলিকান সিনেটর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাকি সবাই কেন মুখে বুজে আছেন অথবা ট্রাম্পের কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন, তার ব্যাখ্যায় বাইডেন বলেন, এঁরা সম্ভবত ট্রাম্পের সামনে কিছুটা ভীত বোধ করেন। পুরো বিষয়টি, বাইডেনের কথায়, খুবই বিব্রতকর। তবে এই চেষ্টায় ট্রাম্প মোটেই সফল হবেন না।
ট্রাম্প প্রশাসনের অসহযোগিতা সত্ত্বেও বাইডেন ও কমলা হ্যারিস ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাইডেন জানান, এই বিষয় নিয়ে তাঁরা এই মুহূর্তে আদালতের আশ্রয় নেবেন না। কোনো রকম সরকারি তহবিল ছাড়াই ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে তাঁরা সক্ষম।
সিনেটে রিপাবলিকানদের নেতা মিচ ম্যাককনেল জোর গলায় বলেছেন, সব ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইডেনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রস্তুত নন। তাঁর কথায়, প্রতিটি বৈধ ভোট গণনা দাবি করার অধিকার ট্রাম্পের রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, আজ অথবা কাল এই প্রক্রিয়া শেষ হবেই।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ট্রাম্পের বকুনির ভয়ে ম্যাককনেল ভোট গণনার দাবি সমর্থন করছেন, তা মোটেই ঠিক নয়। তিনি ভালো ব্যবধানে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন এবং পরবর্তী ছয় বছর তাঁকে নির্বাচনের ঝামেলা পোহাতে হবে না। তাঁর আসল লক্ষ্য সিনেটে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। ৫ জানুয়ারি জর্জিয়ার দুটি সিনেট আসনে ফিরতি ভোট গ্রহণ হবে। উভয় দলের কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় জর্জিয়ার আইন অনুযায়ী এই ফিরতি ভোটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই দুই আসনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জয়ী হলে সিনেটে দুই দলের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৫০-৫০। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সিনেটের সভাপতি হিসেবে একটি ভোটের অধিকারী, সেই জোরে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটদের হাতে চলে যেতে পারে।
এই অবস্থা যাতে না ঘটে, সে জন্য ম্যাককনেলের প্রয়োজন ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের। ট্রাম্পের দোহাই দিয়ে যদি এসব সমর্থককে খেপিয়ে রাখা যায়, তাহলে বিপুলসংখ্যায় তাঁরা ফিরতি নির্বাচনে ভোট দিতে আসতে উৎসাহী হবেন। সে কারণে অযৌক্তিক জেনেও ম্যাককনেল ট্রাম্পের ভোট কারচুপির ভিত্তিহীন অভিযোগ সমর্থন করে যাচ্ছেন।
রিপাবলিকান সিনেটর রিক স্কট এই রণকৌশলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘জর্জিয়ার ফিরতি নির্বাচনে জিততে হলে আমাদের প্রয়োজন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ।’ স্কট ‘পলিটিকো’কে বলেন, ‘আমাদের আশা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব রাখবেন।’
২০২৪ সালে ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে পারেন—এমন একটি গুঞ্জন আগে থেকেই শোনা গিয়েছিল। মঙ্গলবার এক্সিওস ওয়েবসাইটের খ্যাতনামা প্রতিবেদক জনাথন সোয়ান একাধিক রিপাবলিকান সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সে কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন শাসনতন্ত্র অনুসারে কোনো প্রেসিডেন্ট উপর্যুপরি বা পরপর দুবারের অধিক এই পদে আসীন হতে পারেন না। এক দফা বাদ দিয়ে ২০২৪ সালে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তাই ট্রাম্পের কোনো বাধা নেই। জনাথন সোয়ানের কথা অনুযায়ী, ট্রাম্প নিকট মিত্রদের সঙ্গে এই নিয়ে ইতিমধ্যে মতবিনিময় করেছেন। ট্রাম্প যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না, সে কথা তিনি জানেন। তাঁর এই ভাবনা থেকে তা স্পষ্ট, সোয়ান মন্তব্য করেছেন।
কোনো সন্দেহ নেই, ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির ওপর নিকট ভবিষ্যতে প্রবল প্রভাব বজায় রাখবেন। যে সাত কোটি মানুষ এ বছর ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা প্রায় অন্ধভাবে তাঁকে সমর্থন করেন। দলের কোনো পর্যায়ের নেতারই তাই ট্রাম্পকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
দলের ওপর তাঁদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকের ধারণা, কোনো কারণে ট্রাম্প নিজে যদি ২০২৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অসমর্থ হন, তাহলে পিতার জনপ্রিয়তা ও প্রভাবকে ব্যবহার করে ট্রাম্প জুনিয়র বা কন্যা ইভাঙ্কা প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সিএনএন জানিয়েছে, ট্রাম্প জুনিয়র ও তাঁর বান্ধবী কিমবারলি গিলফয়েল তাঁদের পছন্দমতো রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে নিজেদের গুরুত্ব ধরে রাখার জন্য তাঁরা একটি পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি গঠনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই কমিটির প্রধান কাজ হবে ট্রাম্পের সমর্থনে তহবিল সংগ্রহ।