নিজের পাতা ফাঁদে ফেঁসে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের এক টেলিফোন কথোপকথন ধরা পড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ওই কথোপকথনে সামরিক সাহায্য অনুমোদনের বদলে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ছেলে হান্টার বাইডেনের কথিত অপ্রমাণিত দুর্নীতি নিয়ে তদন্তের জন্য ট্রাম্প চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এই তথ্যের ভিত্তিতে ডেমোক্রেটিক পার্টি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন তদন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর কথা ঘোষণা করেছে।
ডেমোক্র্যাটদের প্রবল চাপের মুখে বুধবার সেই কথোপকথনের একটি সারসংক্ষেপ ট্রাম্পের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়েছে।
ট্রাম্প হয়তো আশা করেছিলেন, আলাপের বিবরণ প্রকাশের ফলে অভিশংসনের দাবি স্তিমিত হয়ে আসবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো।
আলাপচারিতার বিবরণ পড়ার পর অধিকাংশ ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য বলছেন, বাইডেন ও তাঁর ছেলের দুর্নীতির কোনো প্রমাণ নেই। এরপরও ইউক্রেনের সরকারকে নিজের (ট্রাম্প) রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যাপারে ক্ষতিকর তথ্য সংগ্রহে উৎসাহ দেওয়াটা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার।
তার চেয়েও বড় কথা, বৈদেশিক সাহায্যকে নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার একটি ক্রাইম বা অপরাধ। একাধিক ডেমোক্রেটিক সদস্য এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
টেলিফোন আলাপের প্রকাশিত বিবরণ অনুসারে, জেলেনস্কি ইউক্রেনের সামরিক চাহিদার কথা উল্লেখ করে ট্রাম্পকে বলেন, তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ট্যাংক-বিধ্বংসী মিসাইল কিনতে আগ্রহী। সে কথার জবাবে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলার বদলে ট্রাম্প প্রস্তাব রাখেন, ‘আপনাকে আমাদের জন্য একটা উপকার করতে বলব।’
ট্রাম্প প্রথমে জেলেনস্কিকে ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় ব্যবহৃত ডেমোক্রেটিক পার্টির কম্পিউটার সার্ভার খুঁজে পেতে সাহায্য করার অনুরোধ করেন। রুশ হ্যাকারদের হাতে এই সার্ভার আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর ট্রাম্প বাইডেন ও তাঁর ছেলের কথিত দুর্নীতির বিষয়টি উত্থাপন করেন।
হান্টার বাইডেন একসময় ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, হান্টার এই কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন। যে অ্যাটর্নি জেনারেল এই কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করছিলেন, বাইডেনের নির্দেশে তাঁকে পদচ্যুত করা হয় বলে ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগেরও কোনো প্রমাণ নেই।
ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বলেন, ‘অনেকেই চায় এই ব্যাপারে তদন্ত হোক। আপনি যদি আমার অ্যাটর্নি জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে এই ব্যাপারে একটা কিছু করতে পারেন, তাহলে খুব ভালো হয়।’
ট্রাম্প নিজের ব্যক্তিগত অ্যাটর্নি রুডি জুলিয়ানির সঙ্গেও এই ব্যাপারে কথা বলতে জেলেনস্কিকে উৎসাহ দেন।
ডেমোক্র্যাটরা বলছে, ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেওয়ার বদলে ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য ক্ষতিকর তথ্য চেয়েছেন, এই বিবরণী থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
মার্কিন কংগ্রেস এর আগে ইউক্রেনের জন্য প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য মঞ্জুর করেছিল, যার মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্যও রয়েছে। ২৫ জুলাইয়ের টেলিফোন আলাপের আগে ট্রাম্প সে অর্থ হস্তান্তর স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।
কংগ্রেসের গোয়েন্দাবিষয়ক কমিটির প্রধান এডাম শিফ বলেছেন, ‘ট্রাম্প একজন মাফিয়া বসের মতো কথা বলেছেন। জেলনস্কিকে তিনি বলছেন, “আমার জন্য একটা কাজ করে দিলে আমিও তোমার জন্য একটা কাজ করব। ” মাফিয়া বসেরা এই ভাবেই কাজ করেন।’
এই টেলিফোন আলাপচারিতার কথা প্রথম জানা যায় একজন হুইসেলব্লোয়ার বা সতর্ককারীর কাছ থেকে। তাঁর পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি গোয়েন্দা বিভাগের একজন সদস্য, যাঁর পক্ষে এই কথোপকথনের বিবরণ পড়া সম্ভব হয়েছিল। তিনিই প্রথম বিষয়টি গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেলের নজরে আনেন। কংগ্রেসের চাপের মুখে হোয়াইট হাউস এই সতর্ককারীর অভিযোগটিও কংগ্রেস সদস্যদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তা পড়ার পর অধিকাংশ ডেমোক্রেটিক সদস্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের দাবি আরও জোরেশোরে তুলেছেন। এই দাবি সমর্থন করেন এমন ডেমোক্রেটিক সদস্যের সংখ্যা এখন ২১৮, যা ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার জন্য পর্যাপ্ত।
রিপাবলিকানদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন সিনেটর ট্রাম্পের ব্যবহার ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে এই সংখ্যা বাড়তে পারে।
জানা গেছে, ডেমোক্রেটিক-প্রভাবিত অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে নির্বাচিত হয়েছেন এমন পাঁচজন সিনেটর অভিশংসন সমর্থনের জন্য চাপের মুখে রয়েছেন।