‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুলিশ সংস্কার শুরু হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেটে পুলিশ সংস্কার আইন উপস্থাপন করা হয়েছে। ডেমোক্রেটরাও পাল্টা প্রস্তাব নিয়ে প্রস্তুত। এর মধ্যেই নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো পৃথক একটি নির্দেশনা জারি করেছেন। নগরীর ট্রাফিক পুলিশকে পরিবহন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সংস্কার বাস্তবায়ন না করলে রাজ্যের তহবিল থেকে স্থানীয় সরকারের বরাদ্দ বাতিলের কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নগরী নিউইয়র্ক দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নগরীর পুলিশ বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নগরীর পুলিশ বিভাগ থেকে ট্রাফিক বিভাগকে আলাদা সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নগরীর ট্রাফিক পুলিশকে পরিবহন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এনওয়াইপিডির আধীনে থাকা স্কুল সেফটি এজেন্টদের দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। নিউইয়র্কে ট্রাফিক বিভাগ ও স্কুল সেফটি বিভাগে কাজ করা এক হাজারের বেশি বাংলাদেশিও এ পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছেন। চাকরির ধরন, মজুরি বা সুযোগ–সুবিধার কোনো পরিবর্তন না হলেও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের অধীনে তাঁদের এখন কাজ করতে হবে।
এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাজ্য ও নগর পর্যায়ে পরিবর্তন ছাড়াও কংগ্রেসে এ নিয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইন পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পুলিশ সংস্কার নিয়ে অচলাবস্থা দূর হতে পারে। যদিও কংগ্রেসে এ নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। রিপাবলিকানরা রক্ষণশীল সংস্কারের কথা বলছেন। এ নিয়ে বিল উপস্থাপন করেছেন সিনেটে। কিছু উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাট নিউইয়র্কের মতো আগ্রাসী সংস্কারের পক্ষে। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ইউনিয়নও তাদের স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষিত হবে, তা নিয়ে লড়াই শুরু করেছে।
১৭ জুন মার্কিন সিনেটে ১০৬ পৃষ্ঠার পুলিশ সংস্কার আইন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর টিম স্কট ও সিনেটে মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককোনেল পুলিশ সংস্কার বিল উপস্থাপন করে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমেরিকার অধিকসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তাই ভালো মানুষ। বিভিন্ন সময়ে কিছু পুলিশের আচরণকে সামাল দেওয়ার জন্য রিপাবলিকান পার্টির আইন প্রস্তাবে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা প্রধানত আইন প্রয়োগের সময়ে পুলিশের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।’
কংগ্রেসে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, কংগ্রেসে উভয় দলের সমঝোতার মাধ্যমে একটা আইন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার আগেই রিপাবলিকান পার্টির এমন উদ্যোগ সমঝোতাকে ব্যাহত করবে। সিনেটের আইন প্রস্তাবটি পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার বিষয়কে এড়িয়ে করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক পুলিশে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর মধ্যেই নতুন নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নগরীর মেয়র ১৭ জুন জানিয়েছেন, এনওয়াইপিডির প্রত্যেক সক্রিয় সদস্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং এ নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। এতে নাগরিকেরা পুলিশ সদস্যদের সম্পর্কে সহজেই জানতে পারবেন। মেয়র বলেন, ‘এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পুলিশ বাহিনীর স্বচ্ছতা নিয়ে আমরা মোটেই বিব্রত নই। সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ বার্তাটিই সবাইকে দেওয়া সম্ভব হবে।’ তিনি বিশ্বাস করেন, গ্রহণযোগ্যতাই সামনে এগিয়ে চলার পাথেয়। এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কে পুলিশের আচরণ নিয়ে সব আলাপ বদলে যাবে। নিউইয়র্ক নগরীর প্রতিটি এলাকায় সামনে এগিয়ে চলার ভিত্তি তৈরি করবে নতুন এ উদ্যোগ।
পুলিশ সংস্কারে পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। আগে পুলিশের গোপনীয়তা আইনের কারণে তা করার সুযোগ ছিল না। সম্প্রতি রাজ্য আইনপ্রণেতারা পুরোনো আইনটি বাতিল করেছেন। দ্বিতীয়ত, এনওয়াইপিডি সদস্যদের বিরুদ্ধে চলমান প্রায় ১ হাজার ১০০ মামলার তথ্য প্রকাশ করা হবে। এসব তথ্যে পুলিশ সদস্যের নাম, আনীত অভিযোগ, শুনানির তারিখ এবং মামলার সিদ্ধান্তের তথ্য উল্লেখ থাকবে। তৃতীয়ত, প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নেওয়া সব ধরনের বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার তথ্য নামসহ উল্লেখ থাকবে। এসব তথ্য নাগরিকেরা যাতে সহজেই জানতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের কোনো সদস্য অসদাচরণের জন্য সাময়িক বরখাস্ত হলে, পুলিশের ব্যাজ বা বন্দুক প্রত্যাহার করা হলে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে। ইন্টারন্যাল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো দুই সপ্তাহ বা তার কম সময়ের মধ্যে তদন্ত ও এ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। আর আগে কখনোই এমন দ্রুততার সঙ্গে পুলিশের স্বচ্ছতা তুলে ধরা হয়নি বলে মেয়র উল্লেখ করেছেন।
দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এনওয়াইপিডি সদস্যদের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকা বডি ক্যামেরার অডিও–ভিডিও এখন থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এসব আচরণগত পরিবর্তন ছাড়াও নিউইয়র্ক পুলিশের দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশ বাহিনী থেকে ট্রাফিক বিভাগকে পরিবহন বিভাগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশি কার্যক্রমে সাধারণ পোশাক বাহিনী থাকবে না। নিউইয়র্ক পুলিশের চলমান বহু কার্যক্রমকে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। সোশ্যাল সার্ভিস বিভাগ পারিবারিক সহিংসতা, গৃহহীনদের খুঁজে বের করাসহ সামাজিক ও কল্যাণকর কাজে সরাসরি এনওয়াইপিডি কর্মকর্তাদের আর দেখা যাবে না।