‘জেফরি অ্যাপস্টিন’ ডকুমেন্টারি বের হয়েছে কয়েক দিন আগে। এতে এই মার্কিন বিলিয়নিয়ারের যৌনতা, অল্পবয়সী মেয়েদের প্রতি তার যৌন স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। তবে তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাবের উৎস এবং এর ব্যাপ্তির সিংহভাগই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এ তথ্যচিত্রে।
কুখ্যাত এই ধর্ষক, দীর্ঘদিন ধরে ছলচাতুরীর মাধ্যমে দায়িত্ব ও জবাবদিহি এড়িয়ে যান। স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ আর নির্লজ্জ লাম্পট্য, এত দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গিয়েও ধরাছোঁয়া ও আইনের নাগালের বাইরে থেকে যান জেফরি। আমেরিকার মতো জবাবদিহির দেশেও আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কুকর্ম চালিয়ে গেছেন এই শতকোটিপতি।
২০১৯ সালের ১০ আগস্ট, কারাপ্রকোষ্ঠে রহস্যজনক মৃত্যু হয় অ্যাপস্টিনের। আর এটিই তাঁর কৃতকর্ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চরম পরিণতি ছিল বলে মনে করা হয়।
জেমস পিটারসন ২০১৬ সালে ‘ফিলদি রিচ’ বইটি লেখেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তথ্যচিত্র করেছে নেটফ্লিক্স। এতে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে অ্যাপস্টিন তাঁর বিত্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভীতি আর প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে অগণিত তরুণীকে তাঁর শিকারে পরিণত করতেন। অ্যাপস্টিনের রহস্যময় ক্যারিয়ার ও তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তর বর্ণনা থাকলেও এতে তাঁর প্রভাব ও কানেকশন সম্পর্কে নতুন তথ্য উপাত্তের তেমন উল্লেখ নেই।
বিশেষ ফন্দি এঁটে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের টার্গেট করতেন অ্যাপস্টিন। আর্থিক সংগতিহীন, অভাবী, উচ্চাভিলাষী পরিবারের আকর্ষণীয় উঠতি বালিকারা ছিল তাঁর টার্গেট। প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ফ্লোরিডার পাম বিচের বিলাসবহুল বাড়িতে নিয়ে যেতেন অ্যাপস্টিন। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শরীর ম্যাসাজ করাতেন।
উৎপীড়ন শেষে অন্য বন্ধুদেরও এনে তাদের আরও বেশি অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব করতেন। এ পদ্ধতি অবলম্বন ছাড়াও অ্যাপস্টিন ও তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী ঘিসলিন ম্যাক্সওয়েল, সুন্দরী মেয়েদের শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগ দিতেন। বিনিময়ে তাঁদের ব্যয়বহুল ওভারসিজ স্কুলিং ও ঢের আর্থিক সুবিধার প্রলোভন দেখাতেন। ডকুমেন্টারি সিরিজটিতে এসব বিষয়ের বিশদ আলোকপাত রয়েছে। তবে এতে কাহিনির আরও কিছু দিক অব্যক্ত রয়ে গেছে। নির্যাতিত নারীদের সাক্ষাৎকারসহ, চার পর্বের এই ডকুমেন্টারি সিরিজে অ্যাপস্টিনের নানা অপরাধের বর্ণনা প্রকাশ পায়।
তবে সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে অপকর্মের অকথ্য যেসব তথ্য রয়েছে, তা উত্তেজনাপূর্ণ, অশ্লীল এবং একই সঙ্গে বিষ্ফোরকও। এসব প্রকাশ পাওয়ায় বিষয়টি বহুল প্রচারিত শুনানি পর্যন্ত পৌঁছাল। কলঙ্কজনক সেই অধ্যায়ের সিংহভাগই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে এই ডকুমেন্টারিতে। বিশেষত অ্যাপস্টিন, এত ক্ষতি সাধনের পরও এত দীর্ঘকাল ধরে কীভাবে পার পেয়ে আসছেন, সে বিষয়ে ‘ফিলদি রিচ’-এ তেমন কোনো ইঙ্গিতই নেই।
অশ্লীলতা ও কুকর্মের শিকার নারীদের বর্ণনায় এক অসীম ক্ষমতাধর, অহংকারী ব্যক্তির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। যিনি দম্ভের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতা আর যৌনতার চর্চা চালিয়ে গেছেন যুগ যুগ ধরে। তথ্যগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং আপত্তিকরও বটে। অথচ অ্যাপস্টিনের এত অসীম ক্ষমতার উৎস, তাঁর রাজনৈতিক ও পেশাগত সংযোগ কোথায়? সমাজের কত উঁচু স্তর পর্যন্ত তাঁর বিচরণ? এমন সব বিষয় প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে।
অ্যাপস্টিনের সম্পদের পরিমাণ এবং এর উৎস সম্পর্কেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। যদিও তাঁকে সচরাচর বিলিয়নিয়ার বলা হয়ে থাকে, কিন্তু তাঁর ঠিক কী পরিমাণ সম্পদ ছিল, তার স্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। এই ব্যক্তি কোনো ধনাঢ্য পরিবার থেকে আসেননি। তাঁর কোনো কলেজ ডিগ্রিও নেই। আশির দশকে ওয়াল স্ট্রিটে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সাবেক সহকর্মীদের মতে, তিনি খুব একটা পারঙ্গম বন্ড ব্যবসায়ী কখনোই ছিলেন না। উপরন্তু ওয়ালস্ট্রিটে কাজ পাওয়ার জন্য নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে মিথ্যাচার করতে হয়েছিল তাঁকে। বাণিজ্যিক রীতি ভাঙার দায়ে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন অ্যাপস্টিন। তা সত্ত্বেও অর্থ-বাণিজ্যের বিশ্বে এত প্রভাবের সঙ্গে, দীর্ঘদিন কীভাবে টিকে থেকে এত বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন—তা অনেকটা বিস্ময় সৃষ্টি করে বৈকি।
অ্যাপস্টিনের ওভারসিজ কোম্পানি ও ব্যাংক হিসাবগুলো রহস্যাবৃত। আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে, রীতিনীতি ও জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যেতেন তিনি। অ্যাপস্টিনের অর্থ-বিত্তের বিষয়ে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্বও রয়েছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এত দিন পরও আজ পর্যন্ত বিষয়টির প্রকৃত চিত্র সামনে আসেনি। সমাজের প্রভাবশালী চক্রের সঙ্গে ওঠাবসা, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং বিকৃত যৌনতার জন্য বালিকা পাচারের নেপথ্যে তাঁর অঢেল সম্পদের উৎস সব সময়ই রহস্যাবৃত থেকে গেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, বিল ক্লিনটন, প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মধ্যেই জেফরি অ্যাপস্টিনের দৌড় সীমাবদ্ধ ছিল না। নানা মানবহিতৈষী কার্যকলাপের মাধ্যমে এমআইটি, হার্ভার্ডের মতো বিশ্বের অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন অ্যাপস্টিন। সেসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যক্তি তাঁর কার্যকলাপ ও আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞাত থাকার প্রমাণ রয়েছে। এমনকি অনেকে সক্রিয়ভাবে এসব বিষয় ধামাচাপা দিয়েছেন এবং এগুলো থেকে অ্যাপস্টিনকে বাঁচিয়ে দেওয়ারও ছুতো খুঁজেছেন বলেও জানা গেছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক রোনান ফ্যারোর মতে, অ্যাপস্টিনের ওপর যখন প্রথম অভিযোগ আনা হলো, জবাবদিহি এড়াতে এমআইটি মিডিয়া ল্যাবকে দেওয়া তাঁর সব অর্থসাহায্যের উৎসকে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে রিপোর্টে দেখানো হয়। ইচ্ছাকৃত ধামাচাপার কারণে উচ্চপদস্থ অনেককেই পদত্যাগ করতে হয়েছে। এমআইটির মিডিয়া ল্যাবের পরিচালক জয় ইটো এদের মধ্যে অন্যতম। অ্যাপস্টিনের অপরাধের মামলা জনসমক্ষে আসার পর এসব প্রতিষ্ঠানের অন্তত ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
অ্যাপস্টিনের বিষয়ে যারা কথা বলেছেন, বিখ্যাত আইনজীবী অ্যালেন ডারসউইটজ তাঁদের অন্যতম, যিনি এই ডকুসিরিজে নিজে নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে পেশাগত চাতুর্যের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ডারসউইটজ। মর্যাদাসম্পন্ন এসব প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, অ্যাপস্টিনের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের ব্যাপারে মুখ খুলবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অ্যাপস্টিনের যেসব কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি সামনে এসেছে, তাতে এসব উচ্চপদস্থদের সঙ্গে অ্যাপস্টিনের সম্পর্ক যে খুব একটা সুস্থ ও নির্দোষ ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়।
‘সুপ্রজনন’ বা ট্রান্সহিউম্যানিজম বিষয়ে অ্যাপস্টিনের এক উদ্ভট রকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। প্রতিবেদনটিতে এ বিষয়টির উল্লেখই করা হয়নি। অথচ নিউইয়র্ক টাইমস ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে অদ্ভুত ও উত্তেজক কিছু তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। অ্যাপস্টিন তাঁর সুবিশাল নিউ মেক্সিকো রেঞ্চে নারীদের ভিন্ন মানব প্রজাতির ডিএনএ দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা করার পরিকল্পনার করেছিলেন। তিনি তাঁর সঙ্গীদের বলেছেন, তিনি নিউ মেক্সিকোর বাড়িতে কয়েকজন নারীকে রেখে তাঁর বাচ্চা ধারণ করাতে চান। এসব সঙ্গীদের কেউ কেউ, বিষয়টি তাঁদের কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল বলে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কেউই এ নিয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করেননি। উপরিউক্ত নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, অ্যাপস্টিন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা চালান। দামি দামি উপহার প্রদান, গবেষণায় অর্থায়ন ও তাঁদের নিয়ে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও অর্থায়ন করেন তিনি। তাঁদের অনেকে আবার এমন উদ্যোগের জন্য তাঁর প্রশংসাও করেন। তবে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক স্টিফেন পিঙ্কারসহ অনেকেই এটাকে গর্দভতুল্য বলে উড়িয়ে দেন।
অ্যাপস্টিনের সঙ্গে অতীতের সম্পৃক্ততার কারণে অনেক উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিই হয়তো জবাবদিহি ও ব্যাখ্যা প্রদানের দায় এড়াতে পারবেন না। যদি কখনো সেই জবাবদিহির বিষয়টি সামনে আসে, তখনই শুধু জানা যাবে কে কে জেফরি অ্যাপস্টিনের কেলেঙ্কারি সিরিজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? কারাগারের ভেতরে অ্যাপস্টিনের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্যও হয়তোবা তখন উদ্ঘাটিত হবে।