আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতিতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাব ওলট-পালট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের পরবর্তী দুই বছর মেয়াদে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
মধ্যবর্তী নির্বাচন নির্বাচিত প্রশাসনের জনপ্রিয়তারও একটি পরীক্ষা। কারণ এতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ভোটারদের একটি বড় অংশই নির্বাচিত সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া থেকে ভোট প্রদান করেন। এই হিসেবে আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় মধ্যবর্তী নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নটি হাজির হয় মূলত ভোটার উপস্থিতির পথ ধরে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের আর মাত্র এক
মাস বাকি। আগামী ৬ নভেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে সাধারণ মানুষের ভোটে কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। বর্তমানে কংগ্রেসের দুই কক্ষই রিপাবলিকান দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বড় শক্তির জায়গা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই শক্তি খর্ব করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে ডেমোক্রেটিক দল। কংগ্রেসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই দলই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ডেমোক্রেটিক দল পরিকল্পনা অনুযায়ী এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে প্রেসিডেন্টের নেওয়া বিভিন্ন পরিকল্পনা কংগ্রেসে পাস করানোর ক্ষেত্রে শক্ত বাধা সৃষ্টি করতে পারবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনেই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হলে ডেমোক্রেটিক দলকে রিপাবলিকান দলের কাছ থেকে ২৩টি আসন ছিনিয়ে আনতে হবে। এটা তেমন কঠিন হবে না হয়তো। একইভাবে সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনেরও বড় সুযোগ রয়েছে দলটির সামনে। মোট ১০০ আসনের মধ্যে ৩৫টি আসনেই নির্বাচন হচ্ছে। আর সিনেটে রিপাবলিকান দল খুবই অল্প ব্যবধানে (৫১-৪৯) এগিয়ে রয়েছে ডেমোক্রেটিক দল থেকে। একই সময়ে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৩৬টিতে গভর্নর নির্বাচন হবে। এই ৩৬টির মধ্যে ২৬টিতে রয়েছেন রিপাবলিকান গভর্নর। এই হিসাবও এবার বদলে যেতে পারে, যা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এখন এমনও হতে পারে যে, দুই কক্ষে দুই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী হবে? এক কথায় ‘অচলাবস্থা’। কারণ এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো বিষয়ে কংগ্রেসের দুই কক্ষ দুটি পৃথক অবস্থান নিতে পারে, যা সরকারি কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
বিভিন্ন জনমত জরিপের ওপর আস্থা রাখলে এটা মনে হতেই পারে যে, এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে ডেমোক্রেটিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হওয়া জনমত জরিপগুলোর পরিণতির কথা মাথায় রাখলে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত এবার রিপাবলিকান প্রার্থীদের বড় বিপাকে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। সাদা চোখে আমেরিকায় লাল সাম্রাজ্য (রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা) নীল ঢেউয়ের সামনে ধরাশায়ী হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালে একটি গোলাপি ঢেউ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। এই গোলাপি ঢেউ যাদের নিয়ে, সেই নারী প্রার্থীরা রিপাবলিকান দলের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছরই সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থী হয়েছেন নির্বাচনে। প্রার্থী হওয়ার কারণ হিসেবে এই প্রার্থীদের একটি বড় অংশই দুটি কথা বলছেন—গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে ‘জোরপূর্বক’ পরাজিত করার প্রতিশোধ এবং ট্রাম্পের বিভিন্ন নারীবিদ্বেষী কথার একটি কড়া জবাব।
সব মিলিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান দল যদি কংগ্রেসে নিজেদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে না পারে, তাহলে আগামী দুই বছরে বড় ধরনের উথাল-পাথালের মধ্য দিয়ে যেতে পারে আমেরিকা। কারণ এমনিতেই একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসকে বেশ নড়বড়ে অবস্থানে নিয়ে গেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ সংশ্লিষ্টতার তদন্ত অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। এ তদন্তের জন্য নিযুক্ত বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের হাতে এমন অজস্র তথ্য রয়েছে, যা প্রেসিডেন্টকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্টকে অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেননি। মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ উল্টে গেলে, এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
আমেরিকায় মধ্যবর্তী নির্বাচন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তমান আমেরিকায় বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসনের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনকে আমেরিকানরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে? পরিসংখ্যান বলছে তেমন একটা নয়।
বিবিসি বলছে, আমেরিকায় মোট ভোটার রয়েছে ৩২ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ কোটি লোক হয়তো ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আগের মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলো অন্তত এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কারণ এখন পর্যন্ত কোনো মধ্যবর্তী নির্বাচনেই ৫০ শতাংশ ভোটারের ভোট পড়েনি। সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল ১৯৬৬ সালে। ২০১৪ সালে ভোট পড়েছিল মাত্র ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ভোট গ্রহণের হার সব সময় ৬০ শতাংশের আশপাশেই ঘোরে। কিন্তু মধ্যবর্তী নির্বাচনে এ হার এতটাই কম যে, তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কারণ যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের আইনসভার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ধারিত হয়, তাতে এত কমসংখ্যক ভোটার অংশ নেন যে, তা রীতিমতো অগণতান্ত্রিক। মোট ভোটারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকেন। অর্থাৎ কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাদের মতামত ছাড়াই নির্ধারিত হয়। ডেমোক্র্যাটরা এবার এই ধারা ভাঙার আহ্বান জানাচ্ছেন ভোটারদের। তাঁরা এই মধ্যবর্তী নির্বাচনকে আমেরিকার ‘ক্রান্তিলগ্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করে, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে এসে নিজের মতামত জানানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফল যার পক্ষেই যাক, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোটা গণতন্ত্রের জন্যই জরুরি। যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ব্যাপক ভোটার উপস্থিতিই বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, যা ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।