বেচারা ট্রাম্প! ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি।
ব্যবসায়িক কারবারে পাকা হতে পারেন ট্রাম্প; কিন্তু রাজনীতিতে যে ব্যবসার চাল অচল, তা দিন দিন বুঝতে পারছেন।
আনকোরা রাজনীতিবিদ ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে একের পর এক ধাক্কা খেয়েই চলছেন। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো—নিজের লোকেরাই তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু।
ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদ মাত্র দেড় বছর। এই মেয়াদের মধ্যে তাঁর প্রশাসনে কত যে নাটকীয় ঘটনা ঘটল, তার ইয়ত্তা নেই।
শুরু থেকে ট্রাম্প প্রশাসনে চলছে অস্থিরতা। এই অস্থিরতায় কতজন গেল আর এল—তার হিসাব রাখাই এখন ভার।
হিসাব কষেই ট্রাম্প তাঁর ঘনিষ্ঠ ও অনুগত লোকদের দিয়ে প্রশাসন সাজিয়ে আসছেন। কিন্তু বিধি বাম! আপন লোকেরাই তাঁকে পিঠে ছুরি মারছেন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার শিবিরের অন্যতম সদস্য ছিলেন মাইকেল ফ্লিন। তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা করেন ট্রাম্প। রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ ওঠায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লিন পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পরই তিনি উল্টে যান। ট্রাম্পই তাঁকে (ফ্লিন) রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন মর্মে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হন ফ্লিন। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন। তদন্তকারীদেরও সহায়তা করছেন।
ট্রাম্পের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ স্টিভ ব্যানন। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁকে হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ করেন ট্রাম্প। গত বছরের আগস্টে ব্যাননকে বরখাস্ত করা হয়। সাংবাদিক মাইকেল উলফের ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ গ্রন্থে ব্যানন ‘বিস্ফোরক’ কথা বলে হইচই ফেলে দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারের সময় রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ট্রাম্প জুনিয়রসহ অন্যদের সাক্ষাৎ ছিল রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। ট্রাম্পকে অযোগ্য বলেও অভিহিত করেন তিনি। ট্রাম্প আর কী করবেন! ব্যাননের ‘মাথা গেছে’ বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন।
গুটিকয়েক আফ্রিকান-আমেরিকানকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে চাকরি দেন। তাঁদের মধ্যে ট্রাম্পের রিয়্যালিটি শোর সাবেক সদস্য ওমারোসা নিউম্যান অন্যতম। তিনি হোয়াইট হাউসের গণসংযোগ কর্মকর্তা হয়েছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি পদচ্যুত হন। এবার ট্রাম্পের গুষ্টি উদ্ধারে নামেন তিনি। ওমারোসার দাবি, ট্রাম্প বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী ও মানসিকভাবে অসুস্থ। ট্রাম্পের অনেক গোপন কথার রেকর্ডিং আছে তাঁর কাছে। এই নারীর কর্মকাণ্ডে রেগে আগুন হন ট্রাম্প। রাগ ঝাড়তে ট্রাম্প ওই নারীকে ‘কুকুর’ ও ‘নীচ’ বলে গাল দেন।
প্রশাসন চালাতে গিয়ে এমনিতেই ট্রাম্পের অবস্থা লেজে গোবরে, তার ওপর ঘনিষ্ঠ লোকদের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ তাঁর ত্রাহি অবস্থা। এরই মধ্যে নতুন ঘটনাপ্রবাহে ট্রাম্পের জীবনে অমাবস্যা নেমে আসার দশা। ট্রাম্পের গোপনীয়তা, তাঁর ব্যবসা-লেনদেনের হাঁড়ির খবর জানেন—এমন কয়েকজন ব্যক্তি এখন সরকারি আইনজীবীদের তদন্তে সহায়তা করছেন।
ট্রাম্পের সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন। তাঁর বিরুদ্ধে কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে। বিষয়টি তদন্ত করছে ফেডারেল কর্তৃপক্ষ। ম্যানহাটনের ফেডারেল আদালতে কোহেন নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে ট্রাম্পকেও ডুবিয়েছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে ট্রাম্পের নির্দেশে এক পর্নো তারকা ও এক মডেলকে মুখবন্ধে অর্থ দিয়েছিলেন বলে কবুল করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার দলের সাবেক প্রধান পল ম্যানাফোর্ট। কোহেনের মতো তিনিও আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংকিং খাতে প্রতারণা, কর ফাঁকি ও বিদেশি ব্যাংকে হিসাব থাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এই বিচারে ট্রাম্পও ফেঁসে যেতে পারেন।
ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের বন্ধু ন্যাশনাল এনকোয়্যারার পত্রিকার মালিক ডেভিড প্যাকার। তিনি ফেডারেল তদন্তে সহযোগিতায় রাজি হয়েছেন। এক মডেলের সঙ্গে ট্রাম্পের গোপন সম্পর্ক ফাঁস না করার জন্য তাঁকে (মডেল) অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধের ব্যবস্থা করেছিলেন প্যাকার।
কোহেনের আর্থিক অনিয়মের তদন্তে সহযোগিতায় সম্মত হয়েছেন ট্রাম্পের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার এলেন ওয়াইসেলবার্গ। ট্রাম্প সাম্রাজ্যের সব তথ্য তাঁর জানা। তদন্তকারীদের তথ্য দেবেন বিবেচনায় ওয়াইসেলবার্গকে আদালত ইমিউনিটি দিয়েছেন।
একান্ত অনুগত হিসেবে জেফ সেশনসকে অ্যাটর্নি জেনারেল করেন ট্রাম্প। সেই সেশনই এখন ট্রাম্পকে চোখ রাঙাচ্ছেন। তিনি সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন, কোনো রাজনৈতিক চাপের কাছে বিচার বিভাগ নতিস্বীকার করবে না। অর্থাৎ, ট্রাম্পের কথায় চলবেন না তিনি। নিরপেক্ষ থাকবেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন।
কাছের লোকেরা মুখ খুলতে শুরু করায় ট্রাম্পের কপালে পুরু ভাঁজ। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। দিশেহারা ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, তিনি এত দিন দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন।
আসলে ট্রাম্প নিজের পাতা ফাঁদেই পড়ছেন।