আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে মার্কিন-সমর্থক সরকারের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তোপের মুখে পড়েছেন।
অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনীতিবিদের পরিচয় নিয়ে বাইডেন গত জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় বসে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র আবার ফিরে এসেছে।
বাইডেনের ওই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র আবার বিশ্ব দরবারে মর্যাদা ও শক্তিমত্তার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে—এমন প্রত্যাশা জাগে সর্বত্র। কিন্তু গতকাল রোববার তালেবানের হাতে আফগান সরকারের পতন বাইডেনের দক্ষ রাজনীতিকের ভাবমূর্তি গুরুতর প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কাবুল থেকে মার্কিন দূতাবাসকর্মী ও নাগরিকদের সরিয়ে আনার দৃশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের করুণ পরিণতির কথাই অনেককে মনে করিয়ে দিয়েছে।
ফলে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিবিদসহ মার্কিন গণমাধ্যমে বাইডেনের কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার ধরন তথা এমন প্রস্থানকে লজ্জাজনক বলে মনে করছে মার্কিনরা।
টানা ২০ বছরের আফগান যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসুক, তা বেশির ভাগ মার্কিনরাই চেয়েছেন। কিন্তু সেই সরে আসতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যে এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হবে, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল রোববার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে না পারার দায় বাইডেনকে নিতে হবে বলে উল্লেখ করছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
কাবুল পতনের আগে-পরের চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বাইডেন প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তালেবানের কাবুলের দিকে ধেয়ে আসার মুখে হেলিকপ্টার দিয়ে মার্কিন দূতাবাসকর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য আমেরিকানদের আহত করেছে।
মার্কিন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, যথাযথ পরিকল্পনা না করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।
মার্কিন গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাও সামনে আসছে। মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছিলেন, ৩০ দিনে কাবুল বিচ্ছিন্ন হতে পারে। আর ৯০ দিনে পতন। কিন্তু গোয়েন্দাদের এই মূল্যায়ন পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্যাম্প ডেভিডে অবকাশযাপন করছেন। তাঁর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের গতকাল রোববার দিনভর অস্থিরচিত্তে আফগানিস্তানে মার্কিন-সমর্থনের সরকার পতনের ধাক্কা সামাল দিতে হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলেকে সংবাদমাধ্যমসহ অন্যদের সামলাতে হয়েছে। তাঁরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে জরুরি সভা করেছেন। এই সভার পর ওয়াশিংটনে অবস্থানরত আইনপ্রণেতাদের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
সংবাদমাধ্যম ‘পলিটিকো’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, মার্কিন আইনপ্রণেতারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফকে তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। যথাযথ পরিকল্পনা না থাকার কারণেই আফগানিস্তানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রশাসনকে দোষারোপ করেছেন আইনপ্রণেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রায়ান ক্ল্যাস বলেছেন, হোয়াইট হাউসের আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা না ছিল বলে নিশ্চিত বলা যায়। বাইডেন প্রশাসনের লোকজন নিজেরাই দাবি করতে পারবেন না যে আফগানিস্তানে মার্কিন অবস্থানের শেষ দিনগুলো ভালোভাবে সম্পাদিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলে আসছিলেন যে তালেবান সহজে আফগানিস্তান দখল করতে পারবে না। মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষিত ও মার্কিন সমর সাজে সজ্জিত আফগান বাহিনী শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে বলেও বলা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, আফগান সেনাবাহিনী কোনো কার্যকর প্রতিরোধই গড়ে তুলে পারেনি। বরং অনেকে তালেবানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অনেকে আগে থেকেই পালিয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল—সে বিতর্কে না গিয়ে কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, বাইডেন প্রশাসনের হাতে যে পরিকল্পনা ছিল, তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়।
প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট সদস্য শেথ মাউল্টন বলেছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা থাকবে কি থাকবে না, এমন প্রশ্নের এখন আর সময় নেই। বরং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে মোকাবিলা করবে।
আমেরিকানদের কাছে অজনপ্রিয় আফগান যুদ্ধের বিশৃঙ্খল অবসান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য রাজনৈতিক বোঝা হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য বাইডেনের পক্ষ থেকে তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গত শনিবার এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, আফগানিস্তানে মাত্র ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রেখে বাকিদের ট্রাম্পের আমলেই প্রত্যাহার করা হয়। ট্রাম্পই সমঝোতা করে গত ১ মের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।