ট্রাম্প সাহসী নাকি বোকা

কে বেশি চালাক? উকিল না মক্কেল?
এক মামলায় জেতার জন্য উকিল ঠিক করলেন, তার মক্কেলকে আদালতে বোবা-কালা সাজাবেন।
কথামত তাই হলো। মামলা জিতলেন। এবার উকিলের ফি পরিশোধের পালা।
মক্কেলকে ফি’র কথা বলতেই সে উকিলের শিক্ষাটাই কাজে লাগাল। পুরো বনে গেল বোবা-কালা।
হতবাক উকিল। যতবার পয়সা খোঁজেন ততবারই মক্কেল একই অভিনয় করেন। ভোঁ। কিছু শুনে না, বলেও না। ধমকেও কাজ হয়নি।
অগত্যা উকিল আশা ছেড়ে দিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকলেন, কোন অলক্ষুনে এমন কুবুদ্ধি তার মাথায় এসেছিল!
তাই প্রশ্ন করছিলাম, কে বেশি চালাক, উকিল না মক্কেল?
ভেবেছিলাম, নববর্ষের আনন্দ আমেজ এখনো ফুরিয়ে যায়নি, হালকা গল্প বলে বলে আজকের লেখাটাও শেষ করব।
তা পারলাম কই? ট্রাম্প বছরের দ্বিতীয় দিন যে উপহার দিলেন, তা হজমের শক্তি কয়জনের আছে?
আমার মন চায় চিৎকার করে কাঁদি। কাঁদলে মনটা হালকা হবে। কিন্তু চিৎকার করে কাঁদব কোথায়? নিউইয়র্কে?
আমার অবস্থা হয়েছে ওই গল্পের মতো।
এক গ্রামে দুষ্টু কিছু ছেলের ইচ্ছে হলো, তারা ঘনবসতির উত্তর বাড়ির গাছ থেকে ডাব চুরি করে খাবে। রাতে একজন উঠল গাছে। নিচে অন্যরা অপেক্ষায় আছে ডাব কুড়াতে। এ সময় একটি ডাব সরাসরি এসে পড়ল এক ছেলের মাথায়। আঘাতে-ব্যথায় সে ককিয়ে উঠল। চিৎকার করে কাঁদতে চাইল। অন্যরা তার মুখ চেপে ধরল। সবাই শুধু ধরা পড়বেই না, উত্তম-মধ্যমের পুরস্কারটাও কপালে জুটবে। তখন ছেলেটি মিনতি করে বলল, তোমরা আমাকে এখুনি খোলা জায়গায় নিয়ে যাও, আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাই।
নিউইয়র্কে কি চিৎকার করে কাঁদা যায় না? যায়, আবার যায় না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদা কে শুনে? বিরক্তিকর। এখানে কথা বলা যায়, আবার যায় না। যেভাবে আমি বলে এসেছি, সেভাবে না। এখানের কথা জানতে হবে, শিখতে হবে। মেপে মেপে, খাপে খাপে মিলিয়ে বলতে হবে। এ স্টাইল রপ্ত করিনি, তাই অনেক সময় বলি না মনের কথা, মনের কথা মনেই থেকে যায়।
কী এক আইন আছে, ভুল করলে রক্ষা নেই। খেসারত দিতে হবে। কথা বলার আগে তা জানা জরুরি। আমি অবশ্য কখনো এসব ঝামেলায় পড়িনি। কারণ আমিতো সবাইকে ভালোবাসি। মনে কোনো ঘৃণা নেই।
একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে বিশেষ আইন। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এতসব পরও তারা ‘হেইট ক্রাইমের’ শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি বেড়েছে নিউইয়র্কে। আমাকে একজন প্রশ্ন করলেন, তাদের কি অপরাধ? কেন তারা ‘হেইট ক্রাইমের’ শিকার হচ্ছে? কি দোষ তাদের?
বললাম, ইতিহাস পড়ুন, সব জেনে যাবেন। শুভ লক্ষণ হলো, নিউইয়র্কে খ্রিষ্টান, মুসলমান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ—সবাই এক ছাতার নিচে সমবেত হয়ে আওয়াজ তুলেছেন, বন্ধ করো হেইট ক্রাইম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক নেতা বলেছেন, ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমরা আছি অন্য এক পৃথিবীতে।
হ্যাঁ, ট্রাম্প সত্যি সত্যি এক রাতেই বদলে দিয়েছেন দুনিয়া। এক কালের ক্যাসিনো মালিক ট্রাম্প জুয়া খুব ভালো বোঝেন। সবচেয়ে বড় চালটা দিয়ে অপেক্ষায় আছেন, বাজিটা তার হলো, না ভিটে-মাটিসহ সব গেল!
ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ট্রাম্পের অদূরদর্শী নেতৃত্ব ও বোকামির সমালোচনায় বিশ্ব মুখর হলেও তিনি তার থোড়াই কেয়ার করেন। তিনি চেয়ে দেখেন তার ‘মোগাব্বো’ খুশ কিনা। রক্ষণশীল বেইস যখন তার পিঠ চাপড়ে বাহবা দেয়, তখন ‘অ্যাডভেঞ্চার’ তার মধ্যে আরও চেপে বসে। রিপাবলিকানদের মধ্যে তিনি এতটাই জনপ্রিয় যে, ইতিমধ্যে জরিপে আব্রাহাম লিঙ্কনকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন। এখন অপেক্ষায় আছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার। এই জুয়ায় যদি বাজিমাত করতে পারেন, তাহলে কে আটকায়?
ট্রাম্প অনেক অনেক সাহসী। নাকি ভিতু? বোকা?
অতীতের প্রেসিডেন্টরা যা করতে চাননি, এক ঝটকায় তিনি তা করে ফেললেন। নিউইয়র্ক টাইমস–এর খবরে জানা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে সব ‘অপশন’ প্রেসিডেন্টের টেবিলে রাখা হতো, তার মধ্যে কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার ‘অপশন’ও থাকত। কিন্তু অতীতে বুশ ও ওবামা এই অপশনে সায় দিতেন না। কারণ তারা মনে করতেন, সোলাইমানিকে হত্যা করলে যে প্রতিক্রিয়া হবে তা সামলানো দুষ্কর হবে। কিন্তু ট্রাম্প চটজলদি এই অপশনটাই বেছে নেন এবং আদেশ করেন সোলাইমানিকে হত্যা করো। সাহস বটে!
ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন স্পষ্ট করে বলেছেন, ট্রাম্প বারুদের বাক্সে জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে মেরেছেন। সাবেক ওবামা প্রশাসনের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, লাদেন বা আলবাগদাদিকে হত্যা আর সোলাইমানিকে হত্যা এক নয়। সোলাইমানি যে দেশের, তার রয়েছে এক সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী।
সোলাইমানিকে হত্যার জন্য বিশ্বে নিন্দা কুড়ালেও ট্রাম্প প্রশংসায় ভেসেছেন ইসরায়েলের কাছ থেকে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, আমরা ‘সেলফ ডিফেন্সের’ যে অধিকার প্রয়োগ করি, ট্রাম্প তাই করেছেন। যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি, ইসরায়েল সম্ভাব্য শত্রুকে আগে-ভাগেই হত্যা করার এক অদ্ভুত নীতি কার্যকর করে যাচ্ছে। গাজা, লেবানন, তিউনিসিয়াসহ নানা দেশে ইসরায়েল তা করেছে।
আমেরিকা ইরানের তেলের জন্য পঞ্চাশের দশকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে শাহ রেজা পাহলভীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। শাহ ইরানের ৮০ ভাগ তেল আমেরিকা ও ব্রিটেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মোসাদ্দেকের সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ইরানের ওপর তখন পাকিস্তানের খুব প্রভাব ছিল। আমেরিকা লিয়াকত আলী খানের কাছে ধরনা দিল, তিনি যেন ইরানের ওপর তার প্রভাব খাটান। তেল যেন আমেরিকা পায়। লিয়াকত আলী খান তা করতে অস্বীকার করেন। ফলে সিআইএ আফগান সরকারের সহযোগিতায় লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করে।
এ সব তথ্য আমরা জানতাম না। পুরোনো গোপন নথি প্রকাশ হওয়ায় জানা গেল। দেশে দেশে গোপন হত্যা—এতো সিআইএয়ের কাছে ‘ডালভাত’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকা ইরানকে যুদ্ধে নামাতে চাচ্ছে। আর ইরান এড়িয়ে যাচ্ছে প্রথাগত যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে কুলোতে পারবে না। তার চেয়ে জেনারেল সোলাইমানির অ-প্রথাগত সমর-কৌশলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এই কৌশলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য বলতে গেলে ইরানের হাতের মুঠোয় চলে আসছে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা এখন তাদের প্রাণ। সোলাইমানি একজন প্রথিতযশা সমরবিদ। তাকে বলা হত, দুনিয়ার এক নম্বর জেনারেল। যুদ্ধকে নিয়ে গেছেন তার দেশের বাইরে।
২০০৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে ইরানের প্রভাব বিস্তারের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ট্রাম্প বুশের সমালোচনায় ছিলেন মুখর। এখন সেই ট্রাম্পই এক হঠকারী কাণ্ড ঘটিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইরানের হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করলেন। সোলাইমানিকে হত্যার ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেছে ইরান। ইরাকের পার্লামেন্টে বিদেশি সৈন্যদের দেশ ছাড়ার প্রস্তাব পাস হয়েছে। ইরানের অভ্যন্তরে বহু মত ও পথের মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়েছে। এমন অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য অতীতে খুব কমই দেখা গেছে। সোলাইমানির শেষকৃত্যে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়ে এক আওয়াজই তুলেছে ‘প্রতিশোধ’ ‘প্রতিশোধ’। সোলাইমানি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন, তার শোকযাত্রায় পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন অর্ধশত ইরানি। ইরাকেও মার্কিন বিরোধী ঐক্য আরও মজবুত হয়েছে।
এদিকে ইরান পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে যাচ্ছে বলে ব্যাপক জল্পনা শুরু হয়েছে। এর কারণ, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করেছে পূর্ণ মাত্রায়। পারমাণবিক চুক্তি থেকে নিজেকে বের করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলেছে, কোন অবস্থাতেই ইরানকে বোমা বানাতে দেবে না। কী করে তা সম্ভব, দেখার জন্য আগামী দিনগুলোতে অপেক্ষায় থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে হয়তো তা সম্ভবপর হতে পারে।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টুইটের পর টুইটে ইরানকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প, যদি তারা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে প্রচণ্ড আঘাত হানা হবে। ইরানের ৫২ লক্ষ্য বস্তুতে বোমা ফেলা হবে, যার মধ্যে রয়েছে ইউনেসকো ঘোষিত ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন। প্রশ্ন উঠল, এত যুদ্ধাপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা কেউ পারে না। তালেবানরা আফগানিস্তানে ও আইএস সিরিয়ায় এ ধরনের অপরাধ করেছে। একই অপরাধ ট্রাম্প করতে চান? পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ট্রাম্পের ঘোষণাকে হালকা করার জন্য বললেন, না, তা হবে না। কিন্তু ট্রাম্প সাংবাদিকদের কাছে তার ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, তারা আমাদের লোকদের হত্যা করতে পারে, আমরা কেন কালচারাল সাইড স্পর্শ করতে পারব না?
৬ জানুয়ারি খবর বের হল, আমেরিকার পক্ষ থেকে ইরাককে চিঠি দেওয়া হয়েছে, আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হবে। কিছুক্ষণ পরই প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের জানালেন, না, সৈন্য সরানো হবে না। ওই চিঠিটি ভুলবশত বিলি করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠল, এ সব হচ্ছেটা কি?
জানি না, এই অস্থিরতা নাকি অদৃশ্য অন্য কোন কারণে কংগ্রেস ট্রাম্পের যুদ্ধ ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অস্থিরতা ও ট্রাম্পের ঘন ঘন হুমকিতে দুটি দৃশ্যপট আমার সামনে ভেসে উঠে।
বেশ আগে মান্নার একটি সিনেমা দেখেছিলাম। রাস্তার অখ্যাত এক ছেলে জায়গা পায় অপরাধীদের এক গ্যাংয়ে। একদিন এই ছেলেটি বড় এক কাজ করে ফেলে। প্রতিদ্বন্দ্বী এক গ্যাং লিডারকে হত্যা করে সে তার ওস্তাদের সামনে হাজির হয়। ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। বলল, ওস্তাদ আমাকে বাঁচান। আমিতো কাম কইরা ফালাইছি।
-কি করছস, বলবি তো।
-ওস্তাদকে (প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাং লিডার) খাইয়া ফালাইছি।
-আরে করছস কি? এখন উপায়?
ছবির কাহিনিতে আছে, পরবর্তীতে এই ছেলেটি সবার সর্দার হয়ে উঠে।
অন্যটি বনের রাজাকে নিয়ে। সিংহের গর্জন খুবই ভয়ংকর। একদিন সিংহকে জিজ্ঞেস করা হলো, আচ্ছা তুমি এত গর্জো কেন?
সিংহের উত্তর, বুঝনা, আমিতো আসলে ডরাই। তাই এই গর্জন। এটা শুনে কেউ কাছে ভিড়ে না।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের এক উক্তি দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম, মাহাথির মোহাম্মদ বলছেন, হয়তো একদিন আমাকে হত্যার জন্য ড্রোন পাঠানো হবে!

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।