ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই যাচ্ছে। সেই নির্বাচিত হওয়ার পরদিন থেকেই অবশ্য এ প্রশ্ন উচ্চারিত হয়ে আসছে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে পরপর দুদিনে বব উডওয়ার্ডের বইয়ের সারাংশ ও নিউইয়র্ক টাইমসে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার বেনামে লেখা সম্পাদকীয় নিবন্ধ যে ঝড় তুলেছে, তা আগে কখনো ওঠেনি।
বিতর্কিত মন্তব্য, হোয়াইট হাউসের পদগুলোকে মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত করা, রুশনীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টাসহ নানা কারণে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের সঙ্গে রুশ আঁতাতের অভিযোগ ওবং এ নিয়ে চলা তদন্ত এই প্রশ্নকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু কোনোটিই এখনো টলিয়ে দিতে পারেনি তাঁর গদি। কিন্তু এখন তেমন সম্ভাবনাই তৈরি হয়েছে।
পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি টলিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের গদি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধানি প্রতিবেদনই নিক্সনকে বাধ্য করেছিল অভিসংশনের মুখে পদত্যাগ করতে। একজন অভিসংশীত প্রেসিডেন্টের অভিধা পাওয়ার বদলে নিক্সন পদত্যাগকেই সম্মানজনক মনে করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, একই বাস্তবতা ধেয়ে আসছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিকে।
বব উডওয়ার্ড তাঁর বইয়ে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রেসিডেন্টের প্রতি হোয়াইট হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনাস্থার বিষয়টি সুস্পষ্ট। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস প্রেসিডেন্টের বুদ্ধিসুদ্ধিকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির পর্যায়ের মনে করেন। চিফ অব স্টাফ জন কেলির চোখে ‘নির্বোধ’ এই প্রেসিডেন্টের অধীনে হোয়াইট হাউস পরিণত হয়েছে এক ‘পাগলা শহরে’। নানান অপ্রেসিডেন্টসুলভ আচরণ দিয়ে ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তাকেই চটিয়েছেন। আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্সকে অনবরত অপমান করা কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টারের আচরণ নকল করাটা তাঁর অভ্যাসের অংশ। তিনি এতটাই খেয়ালি যে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের মতো উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালে, যখন তাঁরই কর্মকর্তারা তাঁর টেবিল থেকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সরিয়ে ফেলেন, তখন তিনি তা টেরও পান না। যদিও এই ডোনাল্ড ট্রাম্পই ক্ষমতায় বসেছিলেন আমেরিকাকে আবারও ‘গ্রেট’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অথচ ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কথা মুহুর্মুহু ঘোষণা করা ট্রাম্পকে তাঁরই কর্মকর্তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় হোয়াইট হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ শঙ্কার বিষয়টি বব উডওয়ার্ডের বইয়ে সবিস্তারে উঠে এসেছে। এ নিয়েই তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে আমেরিকায়। ট্রাম্প ও তাঁর প্রেসসচিব চিরাচরিত পন্থা অনুসরণ করেই এ বইয়ে উঠে আসা তথ্যকে ‘বানোয়াট’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁদের এ চিরায়ত চেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসে ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ। যা লিখেছেন বেনামে হোয়াইট হাউসেরই এক কর্মকর্তা, যিনি নিজেকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তৎপর কর্মকর্তাদের একজন হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এ নিবন্ধে ট্রাম্পের ব্যবহারকে শুধু অস্বাভাবিকই নয়, আমেরিকার স্বার্থের জন্য ‘ক্ষতিকর’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ট্রাম্প ওই কর্মকর্তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং নিউইয়র্ক টাইমসকে ‘কাপুরুষ’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এতে করে যে যুগল বজ্র আঘাত হেনেছে, তার জোর কমছে না।
হোয়াইট হাউসে এরই মধ্যে উপসম্পাদকীয়র লেখককে শনাক্ত করতে নানা তৎপরতা শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নানা নাম উঠে আসছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে সম্ভাব্য লেখক হিসেবে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে এমনকি প্রেসিডেন্টের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জ্যারড কুশনার এবং ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের নামও রয়েছে। রয়েছে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ড্যান ম্যাকগান, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ড্যান কোটস, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ক্যালিঅ্যান কনওয়ে, চিফ অব স্টাফ জন কেলি, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান কার্স্টজেন নিলসেন, আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও জাতিসংঘের মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির মতো নাম। আরও বহু নাম উঠে এসেছে সম্ভাব্য লেখক হিসেবে আলোচনায়, যা হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পবিরোধী অংশটির শক্তিরই পরিচায়ক। এরই মধ্যে অবশ্য মাইক পেন্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ ধরনের নিবন্ধের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, নিবন্ধটি জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা লিখেছেন। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
নিবন্ধটি যে-ই লিখে থাকুন না কেন, তাতে উল্লিখিত তথ্য পাল্টে যাবে না। ওই নিবন্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্যটি হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান কিছু কর্মকর্তা জাতীয় স্বার্থে একাট্টা হয়েছেন। মার্কিন স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে জন্য তাঁরা হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরেই ট্রাম্পবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। এবং এই তথ্য মানুষের সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যেই তাঁদেরই একজন এ নিবন্ধ প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসে। পত্রিকাটি নিজের নীতিমালার বাইরে এসে শুধু গুরুত্ব বিচারে এ নিবন্ধ নাম ছাড়াই প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে নিবন্ধ লেখকের পরিচয় প্রকাশের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে সংবাদপত্রটিকে। কিন্তু তারা এখনো টলেনি।
সব বিচারে বলতেই হয় যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের গদি সত্যি সত্যি একটি বড় ঝাঁকুনির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বব উডওয়ার্ডের বই ও নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় এ ঝাঁকুনিতে নতুন সংযোজন। এর আগের সপ্তাহে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের স্বীকারোক্তি এবং তাঁর প্রচার শিবিরের সাবেক প্রধান পল ম্যানাফোর্টের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই এটি দৃশ্যমান হয়। সে সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল যে, মাইকেল কোহেন নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে দুই পর্নো তারকাকে যে অর্থ দিয়েছিলেন, তার নির্দেশদাতা হিসেবে ট্রাম্প বিচারের আওতায় আসবেন কিনা। সে সময় অপরাধটিকে গুরুতর বলা হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভোগ করা কিছু দায়মুক্তির রীতির কারণে ট্রাম্প বেঁচে যাবেন বলে অনেকে মত দিয়েছিলেন। একই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমার ক্ষমতা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
সর্বশেষ সিনেটের শুনানিতে ট্রাম্প মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতি ব্রেট কাভানো প্রেসিডেন্টের ক্ষমার ক্ষমতা ও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হলে নিজে দায়িত্ব পালন করবেন কিনা এ ধরনের প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এই এড়িয়ে যাওয়াটা তাঁর বিব্রত হওয়ার পরিচায়ক। ব্রেট কাভানোকে মনে করা হয় ট্রাম্প ঘরানার। নিজের পিঠ বাঁচাতেই বিতর্কিত এ ব্যক্তিকে বিচারপতির মতো উচ্চ পদে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু এই মনোনীত লোকও যদি তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যারা এখন সোচ্চার, তাঁরাও ট্রাম্পের নিয়োগ করা।
পুরো বিষয়টি এখন অনেকখানি নির্ভর করছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলের ওপর। কারণ ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবটি পাল্টে যেতে পারে। এদিকে রবার্ট ম্যুলারের তদন্তও যে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তা তো স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রে অভিসংশনের প্রস্তাব ওঠা ও তার টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই যখন পরিস্থিতি তখন নিজের প্রাসাদের সান্ত্রী-মন্ত্রীরাই আর প্রেসিডেন্টের পক্ষে না থাকাটা নিঃসন্দেহে বড় দুর্ভাবনার কারণ। কারণ অভিসংশন ও বিচার দুটিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে তাঁরই কর্মকর্তাদের জোটবদ্ধ বিদ্রোহ কী করে এড়ানো সম্ভব? সব মিলিয়ে টালমাটাল ডোনাল্ড ট্রাম্পের গদি কখন উল্টে যায়, তা সত্যিই বলা যায় না।