আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের নীল তরঙ্গ কি আবারও হোঁচট খাবে রিপাবলিকান লাল উত্তাপের কাছে? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পুরো আমেরিকায়। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আর মাত্র দু সপ্তাহ বাকি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন রিপাবলিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষার জন্য। নিজেকে মার্কিন জাতীয়তাবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ভয়ভীতির কৌশল নিয়ে ভোটারদের উসকে দিচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক দলের বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বার্নি স্যান্ডার্সসহ উদারনৈতিক মহল। ডেমোক্রেটিক দল কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার স্বপ্ন দেখছেন কেউ কেউ। নিদেনপক্ষে ২০২০ সালের পুনর্নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে-এমন প্রত্যাশা ঘোর ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের।
আগামী ৬ নভেম্বর আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদে নিদেনপক্ষে ২৩ আসন ও সিনেটে দুই আসন ছিনিয়ে আনতে পারলে ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। ক্ষমতার ভারসাম্যে বেকায়দায় পড়বেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অতীত ইতিহাসও ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দল প্রতিনিধি পরিষদে গড়ে ৩২ আসন এবং সিনেটে দুই আসন হারিয়েছে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে। তবে এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সুখবোধের কোনো কারণ নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সব তথ্য-উপাত্ত ভেঙে নজির স্থাপন করেছেন আগেই। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাও আবার ঊর্ধ্বমুখী। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল; বেকার সমস্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এমন বাস্তবতায় দেশের নিরাপত্তা, অভিবাসন ভীতি আর আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তিনি আবার মাঠে নেমেছেন। যে রক্ষণশীল ভিতকে উসকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা এখনো প্রকাশ্য। এর মধ্যে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পায়ে হেঁটে অবৈধ অভিবাসীদের কাফেলা আসছে দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে। আমেরিকার অনেক গোঁড়া ট্রাম্প সমর্থক মনে করে, এসব অবৈধ অভিবাসীর কাফেলা আমেরিকাকে দখল করে নেবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সপ্তাহের শুরুতে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যে করেই হোক এ কাফেলা থামাতে হবে। অনেক অপরাধী আসছে। এ কাফেলায় লুকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠী।’ ভীতি ছড়াচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর সমর্থকেরা উদ্দীপ্ত ও উৎফুল্ল। কারণ নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয় নিশ্চিত করার জন্য আগাম ভোটে এগিয়ে আছে রিপাবলিকানরা।
ধারণা করা হচ্ছে সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা ডেমোক্র্যাটদের জন্য ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে উঠছে। প্রতিনিধি পরিষদেও ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি হবে না—এমন কথা বলে বাজি ধরার লোক ক্রমেই কমছে।
২৩ অক্টোবর দেওয়া বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তিনি জাতীয়তাবাদী। বলেছেন, যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক মনে করে, তাদের ভাবনায় নিজের দেশ গুরুত্ব পায় না। এ সময় হাজার হাজার সমর্থক ‘আমেরিকা-আমেরিকা’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত দুজন রক্ষণশীল বিচারককে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিতে পেরেছেন। তাই ভীষণ উদ্দীপ্ত তিনি। প্রচারে নেমে নিজের করনীতির সাফল্যের কথা বলছেন, বেকারত্ব দূর করার কথা বলছেন। আর সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাচ্ছেন অভিবাসীদের নিয়ে। অভিবাসীদের সঙ্গে আমেরিকায় অপরাধীদের প্রবেশ ঘটছে, আমেরিকার জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে ইত্যাদি বলে মাঠ গরম করছেন। সাধারণ মানুষকে অভিবাসী আর নিরাপত্তার ভয় দেখিয়ে সমর্থন আদায়ের পুরোনো কৌশল গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প।
কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট দলের নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘নির্বাচন যদি আজ অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বলতে পারি ডেমোক্র্যাটদের বিজয় অনিবার্য। যদিও দুই সপ্তাহে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হতে পারে।’ পেলোসির কথায় সংশয় সুস্পষ্ট।
নির্বাচনের আগে অন্তত আরও দশটি জনসভায় বক্তৃতা দেবেন প্রেসিডেন্ট। বসে নেই সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। সম্প্রতি এক নির্বাচনী সমাবেশে বারাক ওবামা বলেছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের গোড়া পত্তন তিনিই করে গেছেন। আমেরিকায় অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মহান এ দেশটির মাহাত্ম্য অক্ষুণ্ন রাখার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে আমেরিকার কয়েক কোটি লোকের জন্য এখনো চালু থাকা ওবামাকেয়ার বাতিল হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কার কথাও উচ্চারণ করা হচ্ছে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী সভা থেকে।
ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ পল মাসলিন বলেছেন ‘এবারের নির্বাচনী বছরটি ভিন্ন।’ তবে কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের জয় নিয়ে তীব্র আশাবাদী তিনি। উদারনীতিক নেতা হিসেবে আমেরিকার রাজনীতির মাঠে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলোচনায় আসেন বার্নি স্যান্ডার্স। সপ্তাহের শুরুতে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সতর্ক মন্তব্য করেছেন। ডেমোক্র্যাটদের নীল তরঙ্গে আমেরিকা এবার দুলে উঠবে-এ কথা সহজে মানতে রাজি নন প্রবীণ এ রাজনীতিক। তবে তিনিও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জয় পাওয়া নিয়ে আশাবাদী।
গত দুই সপ্তাহ ধরে নিউইয়র্ক থেকে নাভাদা পর্যন্ত রিপাবলিকানদের নড়াচড়া জোরের সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে চাঞ্চল্যের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে রিপাবলিকান সমর্থকেরা। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ ও অভিবাসী কাফেলার ভয়ে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, ডেমোক্র্যাটদের দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। অনেকেই বলছেন, তারা এমনটি হতে পারে, আগে ভাবেননি। সিনেটে ডেমোক্র্যাট দলের নেতা চার্লস শুমার বলেছেন, তিনি এখনো মনে করেন ডেমোক্র্যাটদের জয় হবে। তবে এদিক-ওদিক কিছু চমক লাগানো ঘটনাও ঘটতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নানা বিতর্কিত কর্মসূচি ঠেকিয়ে রাখার জন্য নিদেন পক্ষে প্রতিনিধি পরিষদের দখল ডেমোক্র্যাটদের প্রয়োজন। সপ্তাহের শুরুতেই আগাম ভোট দিচ্ছেন আমেরিকার অনেক রাজ্যের ভোটারেরা। টেক্সাস থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোট পড়েছে, যার অধিকাংশই রিপাবলিকান ভোট বলে মনে করা হচ্ছে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগানের সূত্র ধরে শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীলদের কাছে মেক ‘আমেরিকা হোয়াইট অ্যাগেইন’ এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। অন্তত তাদের উদ্দীপনা দেখে তাই অনুমান করা হচ্ছে।
সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার আশাও ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে ডেমোক্র্যাটদের। টেনেসিতে রিপাবলিকান প্রার্থী মার্শ ব্ল্যাকবার্ন পরাজিত হবেন, এমন মনে করা হলেও গত কয়েক সপ্তাহে তাঁর জনপ্রিয়তার পালে জোর হাওয়া লেগেছে। অ্যারিজোনা ও নাভাদাতেও সিনেট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের সঙ্গে রিপাবলিকান প্রার্থীদের জনমত জরিপ ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছে। নর্থ ডাকোটার ডেমোক্র্যাট সিনেটর হেইডি হেইটক্যাম্প হেরে যাচ্ছেন, এমন কথাই শোনা যাচ্ছে নির্বাচনের আগে আগে। ডেমোক্র্যাট দলের ইন্ডিয়ানার জো ডোনেলি, মিসৌরির কলারই ম্যাক্কাসকিল, ফ্লোরিডার বল নেলসন বা টেক্সাসের বেটো রোউরকি—কাউকে নিয়েই এখন আর নিশ্চিত নয় দলটি।
রিপাবলিকান দলের বহু প্রার্থী নতুন। তহবিল জোগানসহ নাম পরিচিতিতে পিছিয়ে থাকা এসব রিপাবলিকানের উত্থান ঘটলে আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে ঘটছে উদারনৈতিকদের উত্থান। কিন্তু নিউইয়র্কের মতো উদারনৈতিক রাজ্যই আমেরিকার মূল চিত্র নয়-এ কথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার প্রমাণ করবেন-এমন প্রত্যাশা তাঁর সমর্থকদের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাল (লাল রং রিপাবলিকানদের) উত্তাপে ডেমোক্র্যাটদের নীল (নীল রং ডেমোক্র্যাটদের) ঢেউ কী এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে থমকে দাঁড়াবে? আমেরিকার রাজনীতিতে এ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে, যার উত্তর ৬ নভেম্বরের আগে পাওয়া সম্ভব নয়।