মাইকেল কোহেন এক বছর আগেও ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ফিকশ্চার’। ট্রাম্পের যত কাজ-অকাজ কোহেনের হাত দিয়েই হয়েছে। ফেডারেল তদন্তকারী ও বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের আইনজীবীদের কাছে মিথ্যাচারের অভিযোগে সেই কোহেনকে কারাগারে ‘বেশ লম্বা’ সাজার সুপারিশ করেছেন নিউইয়র্কের ফেডারেল আইনজীবীরা। তাঁদের যুক্তি, কোহেন আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের যোগাযোগের ব্যাপারে কংগ্রেসের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন।
স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল আদালতে সরকারি আইনজীবীরা এই সুপারিশ করেন। ১২ ডিসেম্বর এই আদালতেই সভাপতিত্বকারী বিচারপতি কোহেনের সাজার সময়সীমা নির্ধারণ করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর কমপক্ষে চার বছর সাজা হতে পারে।
এর আগে কোহেন আদালতে এক আবেদনে যুক্তি দেখান, তিনি রবার্ট ম্যুলারের তদন্তের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। সে কারণে তাঁকে কোনো সাজা দেওয়া ঠিক হবে না। সরকারি আইনজীবীরা সে কথা প্রত্যাখ্যান করে জানান, অনেক ক্ষেত্রেই কোহেন পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেননি। তা ছাড়া রবার্ট ম্যুলারের তদন্ত দলের সঙ্গে তাঁর কোনো সহযোগিতা চুক্তিও নেই।
এর আগে কোহেন আয়কর ফাঁকি দেওয়াসহ মোট আট দফা অপরাধে দায় স্বীকার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর অন্যতম হলো ট্রাম্পের পক্ষে পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য উৎকোচ প্রদান। গতকাল রবার্ট ম্যুলার আদালতে পেশকৃত তাঁর নথিতে ট্রাম্পকে ‘এক নম্বর ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে এই উৎকোচ প্রদানের ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন। এক নম্বর ব্যক্তির নির্দেশে ও কোহেনের সঙ্গে যৌথভাবে এই উৎকোচ প্রদান সম্পন্ন হয়। এর আগে কোহেন স্বীকার করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতেই তাঁর মুখ বন্ধ রাখার শর্তে ড্যানিয়েলসকে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দেওয়া হয়।
সরকারি আইনজীবীরা বলছেন, নির্বাচনের ঠিক আগে এই অর্থ প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করা হয়েছে। ম্যুলারের পেশকৃত নথির ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প বলেছেন, আবারও প্রমাণিত হলো, রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আঁতাত তিনি করেননি। তবে বেশির ভাগ আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন, কোহেনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে নির্বাচনী আইনভঙ্গের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ট্রাম্পও কার্যত একই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। বিভিন্ন ভাষ্যকার সেই কারণে তাঁকে ‘অভিযুক্ত নয় এমন একজন সহষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
কোহেনের সূত্রে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সম্পর্কের নতুন তথ্য প্রকাশ করেছেন রবার্ট ম্যুলার। তাঁর পেশ করা তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালের দিকে কোহেন রুশ মধ্যস্থতাকারীর কাছ থেকে ট্রাম্প ক্যাম্পেইন ও রুশ সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার প্রস্তাব পান। এই ব্যক্তি ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজনেরও প্রতিশ্রুতি দেন। এই ব্যক্তি জানান, এই যোগাযোগ অর্জিত হলে ট্রাম্প শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, ব্যবসায়িকভাবেও ‘দারুণ লাভবান’ হবেন।
এক সপ্তাহ আগে কোহেন স্বীকার করেন, মস্কোতে ট্রাম্প হোটেল নির্মাণের ব্যাপারে কোহেন ট্রাম্পের পক্ষে রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান। আগে এ কথা চেপে গেলেও ট্রাম্প এখন বলছেন, হোটেল নির্মাণের ব্যাপারে ‘হালকাভাবে’ কথাবার্তা হয়, তবে কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। তা ছাড়া এতে বেআইনি কিছু আছে বলে তিনি মনে করেন না।
তদন্তের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে ভাষ্যকারেরা বলছেন, ম্যুলার এই মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিষয়েই সব মনোযোগ নিবেশ করছেন। গতকাল ম্যুলার যে নথি পেশ করেন, তাতে বলা হয়, মস্কো হোটেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ট্রাম্প ও তাঁর কোম্পানি বিপুলভাবে লাভবান হত। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন যখন তুঙ্গে, তখনো কোহেন ও ট্রাম্প এই প্রকল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখেন।
একই দিন ওয়াশিংটন ডিসির একটি ফেডারেল আদালতে ম্যুলারের আইনজীবীরা ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন চেয়ারম্যান পল ম্যানাফোর্টকে মিথ্যাচারের নতুন অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ একজন সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর অব্যাহত যোগাযোগের ব্যাপারে তিনি ম্যুলারের কাছে মিথ্যাচার করেছেন। এর আগে কর ফাঁকি ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ম্যানাফোর্ট ম্যুলারের সঙ্গে সহযোগিতায় সম্মত হন। কিন্তু ম্যুলার জানিয়েছেন, মুখে সহযোগিতার কথা বললেও ম্যানাফোর্ট একের পর এক মিথ্যা বলে গেছেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁর আইনজীবীরা গোপনে ট্রাম্পের আইনজীবীদের সঙ্গেও কথাবার্তা চালিয়ে যান।
ভাবা হচ্ছে, ট্রাম্পের কাছ থেকে ক্ষমা পাবেন—এই বিশ্বাসে ম্যুলারের সঙ্গে সহযোগিতার বদলে ম্যানাফোর্ট মিথ্যাচারের পথ অনুসরণকে বেশি লাভজনক মনে করেন।