রাজনীতিবিদদের মিথ্যা বলাটা বিরল নয়। তবে মিথ্যাকে রীতিমতো শিল্পে পরিণত করে বিরল নজির স্থাপন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিথ্যা দিয়ে তিনি তাঁর প্রেসিডেন্সি শুরু করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতা টানা চার বছর বজায় রেখে যথারীতি মিথ্যা দিয়েই ক্ষমতা ছেড়েছেন ট্রাম্প।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ট্রাম্প যখন নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন, তখন সবাই তাঁর এই সিদ্ধান্তকে অনেকটা ‘রাজনৈতিক মশকরা’ হিসেবে নিয়েছিলেন। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলাকালে কেউই ট্রাম্পকে ‘গণনায়’ ধরেননি। সেই ট্রাম্পই সবাইকে পেছনে ফেলে, দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ঝানু প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন।
তারপর নানা বিষয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েন। তবে ট্রাম্পের গড়া অধিকাংশ ইতিহাস-রেকর্ড নিন্দনীয় হিসেবে গণ্য। ট্রাম্পের বাজে রেকর্ডগুলোর মধ্যে কোনটি আগে আর কোনটি পরে উচ্চারিত হবে, তা নির্ধারণ করা বেশ মুশকিলই বটে। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিথ্যা দিয়ে ট্রাম্প বিস্ময়কর রেকর্ড গড়েছেন।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের অভিষেক হয়েছিল। সেই অভিষেক নিয়েই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যার অভিষেক হয়। এ প্রসঙ্গে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার চিফ হোয়াইট হাউস করেসপনডেন্ট পিটার বেকার সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, ট্রাম্প তাঁর প্রেসিডেন্সি শুরু করেছিলেন মিথ্যা দিয়ে। তাঁর সেই মিথ্যা ছিল অভিষেক অনুষ্ঠানে জনতার উপস্থিতি নিয়ে। শুরু থেকেই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি মিথ্যার কারখানা হিসেবে কাজ করে।
মিথ্যা দিয়ে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি শুরু করার প্রমাণ সিএনএনও হাজির করে। তারা জানায়, অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় হওয়া বৃষ্টি নিয়ে শুরুর মিথ্যাটা বলেছিলেন ট্রাম্প।
হোয়াইট হাউসে পা রাখার পর থেকে শুরু করে ক্ষমতার চার বছরে ট্রাম্প মিথ্যার ‘সুনামি’ বইয়ে দেন। ট্রাম্পের মিথ্যার একটা হিসাব ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ‘ফ্যাক্ট চেক’ থেকে পাওয়া যায়। পত্রিকাটি জানায়, ২০২০ সালের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ২০ হাজার মিথ্যার ‘মাইলফলক’ স্পর্শ করেন। আর ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাম্প ২৯ হাজার ৫০৮টি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেন।
২০২০ সালের ৫ নভেম্বরের পর থেকে ট্রাম্পের ক্ষমতার বাকি দিনগুলোয় তাঁর মিথ্যার সংখ্যা অনায়াসেই ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে তখনই আভাস দেওয়া হয়েছিল। ৫ জানুয়ারি দ্য ইনডিপেনডেন্ট অনলাইনের এক প্রতিবেদনেও একই সম্ভাবনার কথা বলা হয়। কারণ, ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ট্রাম্প দিন-রাত মিথ্যা বলছিলেন।
ঠিক হয়েছেও তাই। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ফ্যাক্ট চেক হিসাব অনুযায়ী, চার বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩০ হাজার ৫৭৩টি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন।
ফ্যাক্ট চেক হিসাব দেখা যায়, গত বছরের জুন থেকে নির্বাচন যত এগিয়ে এসেছে, ট্রাম্পের মিথ্যা বলার প্রবণতা তত বেড়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রায় চার হাজার মিথ্যা বলেন। তিনি পুরো ২০১৭ সালে যত মিথ্যা বলেছেন, তার দ্বিগুণ বলেছেন এই এক মাসে। পরের মাস নভেম্বরেও ট্রাম্পের মিথ্যা বলা যথারীতি অব্যাহত ছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে গত ২ নভেম্বর তিনি দৈনিক মিথ্যার সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েন। ২৪ ঘণ্টায় ট্রাম্প পাঁচ শতাধিক মিথ্যা বলেন। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের রাত থেকে ট্রাম্প লাগাতার মিথ্যা বলা শুরু করেন।
সিএনএনের ওয়াশিংটন ব্যুরোর সাংবাদিক ড্যানিয়েল ডেল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রকাশ্যে বলা কথা বা টুইটের সত্যতা যাচাই (ফ্যাক্ট চেক) করেছেন। এ কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এটা ছিল তাঁর জন্য একটি কঠিন ও অস্বাভাবিক কাজ। তিনি সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর ট্রাম্পের দৈনিক মিথ্যা বলার পরিমাণ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে এর হিসাব রাখাটা তাঁর জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। মিথ্যার হিসাব রাখায় তিনি রণেভঙ্গ দেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প মিথ্যার চর্চাকে একটা অন্য পর্যায়ে নিয়ে যান। তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে, দারুণ আত্মবিশ্বাসে, নিয়ম করে হাজারো মিথ্যা বলে গেছেন। একই মিথ্যা বারবার, দিনের পর দিন, ক্রমিকভাবে বলেছেন। যেমন: মার্কিন অর্থনীতি, ইউক্রেন কেলেঙ্কারি, করোনাভাইরাস মোকাবিলা, নির্বাচনে জালিয়াতি প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা বলার কৌশল ব্যবহার করেছেন।
মিথ্যার সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে সিএনএনের ড্যানিয়েল ডেল বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সব সময়, প্রায়ই কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়া, সবকিছু নিয়ে মিথ্যা বলতেন। মিথ্যাকে তিনি তাঁর জীবনের একটি উপায় হিসেবে নিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তাঁর মেয়াদের পুরোটা সময় মিথ্যাকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন ‘ফেক নিউজ’ তকমা। প্রাণঘাতী করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে তাঁর মিথ্যা দাবির পর যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন।
সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্প মিথ্যার বেসাতি করেছেন। নির্বাচনে কারচুপি-জালিয়াতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে তিনি নিজেকে জয়ী দাবি করেছেন। এই মিথ্যা দিয়ে তিনি তাঁর সমর্থকদের উসকে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে রক্তক্ষয়ী হামলার কারিগর হিসেবে কাজ করেন।
নির্বাচনে জয়ের ডাহা মিথ্যায় অনড় থেকেই ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা ছাড়েন ট্রাম্প। এমনকি এদিন অ্যান্ড্রুজ সামরিক ঘাঁটিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদায়ী ভাষণেও ছিল একগাদা মিথ্যা।