যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মামলা খারিজ করে দিয়েছেন।
পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোটের ফলাফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনকে প্রত্যয়ন না করার জন্য সেখানকার আদালতে আবেদন জানানো হয়েছিল। পেসিলভানিয়ার আদালত আগেই ট্রাম্প শিবিরের এ মামলা খারিজ করেন। এ মামলার আপিল নিয়ে ট্রাম্প শিবির সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। ট্রাম্পের আশা ছিল, সুপ্রিম কোর্টে তাঁর নিয়োগ দেওয়া তিনজন রক্ষণশীল বিচারপতির আনুকূল্য পাবেন। কিন্তু ৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্প শিবিরের মামলাটি খারিজ করেন। ফলে, ট্রাম্প আরেকটা বড় ধাক্কা খেলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেলেও ট্রাম্প ২০ জানুয়ারির আগপর্যন্ত নাটক জমিয়ে রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, তিনি এখন পর্যন্ত ক্ষান্ত দিচ্ছেন না।
মার্কিন নির্বাচনবস্থা এমনিতেই জটিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবার তাকে আরও জটিল করে তুলছেন। নির্বাচনী বিরোধ ঝুলিয়ে রেখে ট্রাম্প ফলাফল পাল্টে দিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার নানা চেষ্টা করছেন। তবে ট্রাম্পের এসব চেষ্টা সফল হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচনী আইনে নিরাপদ সময় হিসেবে ৮ ডিসেম্বরের কথা উল্লেখ রয়েছে। অঙ্গরাজ্যগুলোকে এই তারিখের মধ্যে নির্বাচনী সব বিরোধ নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ২০ জানুয়ারি তারিখকে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে।
ট্রাম্পের আইনজীবীরা ২০০০ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুথ গিনসবার্গের ‘রেফারেন্স’ দিচ্ছেন। জর্জ বুশ ও আল গোরের মধ্যে নির্বাচনী মামলায় বিচারপতি গিনসবার্গ ইলেক্টোরাল ভোট নিয়ে ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের অধিবেশনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের একাধিক মামলা ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। সর্বশেষ টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটন অন্য চার অঙ্গরাজ্যের ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্টে। এই পদক্ষেপকে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া বা সময়ক্ষেপণের আরেকটি হীন প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
মামলায় জর্জিয়া, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্য ভোটে অনিয়মে জড়িত ছিল এবং তার তদন্ত প্রয়োজন বলে আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনে এই চার অঙ্গরাজ্যের ফলাফল বাতিল ও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যয়নের সময়সীমা ১৪ ডিসেম্বর থেকে বাড়ানোর আদেশ চাওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-উত্তর রাজনীতি এখন নতুন দৃশ্যপটে প্রবেশ করছে। ইলেক্টোরাল কলেজ আনুষ্ঠানিকভাবে বাইডেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করেনি। তার আগপর্যন্ত বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচনী আইনে বলা আছে, ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় বুধবারের পরের প্রথম সোমবার ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ বছর এই দিনটি পড়েছে ১৪ ডিসেম্বর।
সব অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী আইন এক নয়। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজ তাদের অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের মতামত উপেক্ষা করে ভিন্ন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। কিংবা কোনো প্রার্থীকেই ভোট প্রদানে বিরতও থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইলেক্টোরাল কলেজের কোনো কোনো সদস্যের এর আগে অঙ্গরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপেক্ষা করে ভোট দেওয়ার নজির রয়েছে। তবে ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো ইতিহাস নেই। ট্রাম্প এখানে একটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচনী আইনে বলা আছে, অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ওয়াশিংটনে অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। অঙ্গরাজ্য থেকে প্রত্যয়ন করে সিলগালা করে ফলাফল ভাইস প্রেসিডেন্ট বরাবরে প্রেরণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সিনেটের নতুন সদস্যরা ৩ জানুয়ারি দুপুরে শপথ গ্রহণ করবেন। ১১৭তম মার্কিন কংগ্রেসের যাত্রা এদিন থেকেই শুরু হবে। যদিও এবারের নির্বাচনে জর্জিয়ায় সিনেটের দুই আসনে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে, জর্জিয়ার নির্বাচনে জয়ী দুই সিনেট সদস্য ৫ জানুয়ারির পর দ্রুততম সময়ে শপথ নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেবেন।
৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে অঙ্গরাজ্য থেকে পাওয়া ইলেক্টোরাল ভোট খোলা হবে। এমন যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ইংরেজি বর্ণের আদ্যক্ষরের ক্রমানুসারে কংগ্রেস ও সিনেটের দুজন নিয়োগ করা কর্মকর্তা অঙ্গরাজ্য থেকে আসা ফলাফল পাঠ করে শোনাবেন। সব ফলাফল যোগ করে ভাইস প্রেসিডেন্ট ফলাফল ঘোষণা করে কারও কোনো আপত্তি আছে কি না, তা জানতে চাইবেন।
আপত্তি নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সিনেট ও কংগ্রেস আলাদাভাবে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটের পুনর্গণনা করতে পারবে।
ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ৫৩৮টি। এর মধ্যে ২৭০টি ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই কোনো প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
২৭০ ভোট কোনো প্রার্থী না পেলে কংগ্রেসের ৪৩৫ জন সদস্য নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের একটি ভোট থাকবে। কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সিনেটে এখন পর্যন্ত রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অঙ্গরাজ্য প্রতি এক ভোটের হিসাবে কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও ট্রাম্প নির্বাচিত হতে পারেন! অঙ্কের হিসাবে তার সম্ভাবনার কথা বলা হলেও বাস্তবে এমন কিছু হবে বলে কেউ মনে করছে না।
কংগ্রেস এসব নিয়ে কোনো জটিলতায় পড়লে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণার জন্য ২০ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত সময় নিতে পারবে। যদি ২০ জানুয়ারি দুপুরের মধ্যে কংগ্রেস কোনো সমাধানে না আসতে পারে, তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার উত্তরাধিকারে পরবর্তী যোগ্য ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন।
মার্কিন সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনের দিন থেকে ২০ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্টের মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। বিরোধের কারণে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে ব্যর্থ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। যদি কংগ্রেস ও সিনেট প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যর্থ হন, সে ক্ষেত্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন কংগ্রেস একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে এমন জটিলতা সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। তবে ট্রাম্প যত ধরনের বিরোধ উপস্থাপন করা যায়, তা করতে পারেন। ২০ জানুয়ারির আগপর্যন্ত ট্রাম্পের এই নাটক চলতে পারে। তবে তার মধ্যে এক ফাঁকে তিনি নাটকীয়ভাবে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করতে পারেন বলেও বলছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম।