ফ্লোরিডায় ভোটারদের উপস্থিতিতে এনবিসি টিভির আয়োজনে টাউন হল সভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ফ্লোরিডায় ভোটারদের উপস্থিতিতে এনবিসি টিভির আয়োজনে টাউন হল সভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্পের বেসামাল বৃহস্পতিবার

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মন্দ খবর পাচ্ছিলেন। সন্ধ্যায় ফ্লোরিডায় ভোটারদের উপস্থিতিতে এনবিসি টিভির আয়োজনে তাঁর টাউন হল সভা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। তিনি সাধারণত ফক্স নিউজের বন্ধুসুলভ সাংবাদিকদের নিরাপদ প্রশ্নের উত্তর দিতে অভ্যস্ত। এদিন অবস্থা ভিন্ন হতে পারে, বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি দুপুরেই সভাটিকে ‘পাতানো ফাঁদ’ বলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেন। অভিযোগের সুরে বললেন, ‘জো বাইডেন সব সময় সহজ প্রশ্ন পান। আমার বেলাতেই কঠিন সব প্রশ্ন।’

ঠিক কতটা কঠিন প্রশ্ন হবে, তা ট্রাম্পের ভাবনার ঊর্ধ্বে ছিল। তাঁর অসংলগ্ন উত্তর শুনে সঞ্চালক সাভানাহ গাথরি একসময় বিরক্ত হয়ে উঠলেন। ট্রাম্পকে বলে বসলেন, ‘আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। কারও পাগলাটে বুড়ো কাকাবাবু নন।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন।

টাউন হল সভার আগে ট্রাম্পের জন্য আরও কঠোর সমালোচনা অপেক্ষা করছিল। এদিন ফাঁস হওয়া এক অডিও রেকর্ডিং অনুসারে, নেব্রাস্কার রিপাবলিকান সিনেটর বেন স্যাস বলেছেন, শুধু রিপাবলিকান হিসেবে নয়, আমেরিকান হিসেবেও ট্রাম্পের অবস্থান তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একনায়কদের ‘তোষামোদে ব্যস্ত’। তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র নিজের মিত্রদের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। স্যাস আরও বলেন, নারীদের প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব অগ্রহণযোগ্য। তিনি মাতাল নাবিকের মতো অর্থ ব্যয় করেন। দরজার আড়ালে খ্রিষ্টপন্থী ইভানজেলিক্যালদের ঠাট্টা করেন, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতি সদয় মনোভাব পোষণ করেন এবং তাঁর পরিবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বটাকে একটা ব্যবসার সুযোগ বলে মনে করে। স্যাসের প্রতিটি কথা ছিল ট্রাম্পের প্রতি চপেটাঘাত।

বেন স্যাসের বক্তব্যের অডিও টেপ ফাঁস হতে না–হতেই ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ক্রিস ক্রিস্টির একটি লিখিত বক্তব্য প্রকাশিত হয়। দুই সপ্তাহ আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে মনোনীত অ্যামি কোনি ব্যারেটকে পরিচয় করিয়ে দিতে হোয়াইট হাউসে এক অনুষ্ঠান হয়। তাতে অংশ নিয়ে যে এক ডজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন, তাঁদের একজন ক্রিস্টি। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি বলেছেন, ‘মাস্ক না পরে আমি ভুল করেছিলাম। আমার এই ভুল থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত।’

এটাই শেষ নয়। সন্ধ্যার পরপর ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডলফ জুলিয়ানির মেয়ে ক্যারোলিন জুলিয়ানির এক নিবন্ধ। তাতে তিনি ট্রাম্পের বদলে বাইডেনের পক্ষে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। ‘আমাদের সম্মিলিত দুঃস্বপ্নের সমাপ্তির জন্য এ ছাড়া অন্য পথ নেই’, লিখেছেন ক্যারোলিন।

টাউন হলে বিপর্যস্ত ট্রাম্প

বৃহস্পতিবার এনবিসি টিভির টাউন হলে অংশ নেন ট্রাম্প। একই দিন একই সময়ে এবিসি টিভির টাউন হলে অংশ নেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। এদিন দুই প্রার্থীরই পূর্বনির্ধারিত ‘ভার্চ্যুয়াল’ টাউন হলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প ‘ভার্চ্যুয়াল’ সভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালে বেসরকারি বিতর্ক কমিশন তা বাতিল করে দেয়।

ট্রাম্প তাঁর টাউন হলের সভায় অভ্যাসমতো প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সঞ্চালক সাভানাহ গাথরি যেভাবে চেপে ধরেন, তাতে তাঁর উত্তর অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। অন্যদিকে জো বাইডেন অতি ধীরেসুস্থে, কারও কারও মতে অতিরিক্ত ধীরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে জেরার মুখে ট্রাম্প দাবি করেন, ২৯ সেপ্টেম্বর বাইডেনের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি বিতর্কের আগে শর্তানুযায়ী তাঁর কোভিড পরীক্ষা ‘নেগেটিভ’ হয়েছিল কি না, তা তাঁর মনে নেই। ‘হয়তো করেছি, হয়তো করিনি,’ এমন উত্তর দেন ট্রাম্প। এর আগে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছিল, ট্রাম্প প্রতিদিন এক বা একাধিকবার কোভিড পরীক্ষা করান। এদিন জেরার মুখে তিনি বলেন, রোজ নয়, তবে ঘন ঘন পরীক্ষা হয়। সঠিক উত্তর তাঁর চিকিৎসক জানেন। কোভিড সংক্রমণের কারণে তাঁর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে, এ কথাও প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন ট্রাম্প।

এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প কার্যত আয়কর ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নেন। বলেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিনি মাত্র ৭৫০ ডলার ফেডারেল আয়কর দিয়েছেন। তাঁর কাছে বিদেশি ব্যাংকের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ রয়েছে, এ কথাও স্বীকার করে বলেন, এই অর্থ তাঁর পুরো সম্পত্তির অতি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।

ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, কিউ আনন নামের অতিদক্ষিণপন্থী একটি গ্রুপের সমালোচনা না করা। অলীক ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্য পরিচিত এই গ্রুপের দাবি, ডেমোক্র্যাটরা পেডোফিলিয়া বা শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত একটি গুপ্তচক্র। ট্রাম্প এর আগে গ্রুপটির প্রতি ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প দাবি করেন, এদের সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। জবাবে সঞ্চালক গাথরি ফোড়ন কাটেন, ‘আপনি ঠিকই জানেন।’ একপর্যায়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি এটুকু জানেন, গ্রুপটি পেডোফিলিয়াবিরোধী, যা তিনি সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য যে কিউ আননকে (এফবিআই যাদের ‘ঘরোয়া সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করেছে) উৎসাহিত করবে, তাতে সন্দেহ নেই।

এর আগে ট্রাম্প প্রাউড বয়েজ নামের একটি বর্ণবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সমালোচিত হয়েছিলেন। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নিন্দা করার ব্যাপারে তাঁর দোনোমনা ভাব কেন? জানতে চেয়েছিলেন সঞ্চালক গাথরি। এতে ক্রুদ্ধ ট্রাম্প বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি তাদের নিন্দা করছি। আপনার পরের প্রশ্ন কী?’

ট্রাম্প কিছুদিন আগে এক টুইটে দাবি করেছিলেন, ওবামা প্রশাসন ওসামা বিন লাদেনের হত্যার যে দাবি করে, তা আসলে ভুয়া বা সাজানো। এই জাতীয় ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ তিনি কীভাবে প্রচার করলেন, জানতে চাওয়া হলে ট্রাম্প বলেন, তিনি অন্য একজনের করা টুইট পুনর্বণ্টন করেছেন মাত্র। প্রেসিডেন্টের এমন কথায় বিরক্ত হয়ে গাথরি বলেন, ‘আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। কারও পাগলাটে বুড়ো কাকাবাবু তো নন যে যার–তার টুইট বিলি করবেন।’

কোনি ব্যারটের মনোনয়ন, একমাত্র সুখবর

এদিন ট্রাম্পের জন্য একমাত্র সুখবর ছিল বিচারপতি হিসেবে অ্যামি কোনি ব্যারটের মনোনয়ন নিয়ে শুনানি। তিনি বিচারপতি রুথ বাইডার গিন্সবার্গের শূন্য আসনে ট্রাম্পের মনোনীত প্রার্থী। বৃহস্পতিবার ছিল মার্কিন সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির সামনে এই শুনানির শেষ দিন। ডেমোক্র্যাট সিনেটরদের পুনঃপুন আক্রমণ সত্ত্বেও ব্যারেট অধিকাংশ বিতর্কিত প্রশ্ন সাফল্যের সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়ায় ট্রাম্প অত্যন্ত খুশি। নির্বাচনের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে এই নিয়োগ নিয়ে তড়িঘড়ি আয়োজনের জন্য তিনি ডেমোক্র্যাটদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন। রিপাবলিকান কৌশলবিদদের ধারণা, আরও একজন রক্ষণশীল বিচারককে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হলে তা দেশের রক্ষণশীল, বিশেষত ইভানজেলিক্যাল ভোটারদের উদ্দীপ্ত করবে। জিততে হলে এই ভোটারদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ট্রাম্পের জন্য অপরিহার্য।

পরীক্ষায় উতরে গেলেন বাইডেন

পক্ষান্তরে, এবিসির টাউন হলে বাইডেনের লক্ষ্য ছিল কোনো বড় ভুল না করা। কখনো কখনো অতিরিক্ত লম্বা উত্তর দেওয়া ছাড়া এদিন উটকো কোনো ঝামেলায় তিনি পড়েননি। বাইডেনের টাউন হল চলাকালে ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টা এক টুইটে টিপ্পনী কেটে বলেন, ‘বিতর্ক নয়, মনে হচ্ছে টিভিতে একটি শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখছি।’

বাইডেন স্বীকার করেন, ১৯৯৪ সালে ক্লিনটন আমলে প্রস্তুত আফ্রিকান-আমেরিকানবিরোধী ‘অপরাধ আইন’ সমর্থন একটি ভুল ছিল। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস প্রশ্নে তিনি বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে চলবেন এবং নির্বাচিত হলে রিপাবলিকানদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন। ‘ঠাট্টা নয়, আমি ফোন করে তাদের বলব, আসুন, একসঙ্গে কাজ করি,’ বলেন বাইডেন।

এর আগে সুপ্রিম কোর্টের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্নে বাইডেন নির্বাচনের আগে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এদিন তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন। বাইডেনের টাউন হলের এটিই ছিল একমাত্র উল্লেখযোগ্য খবর।