সন্ত্রাসী হামলার মামলায় আকায়েদ

ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলাম

আকায়েদ উল্লা
আকায়েদ উল্লা

‘আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলাম। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বোমা ফেলবেন বলেছিলেন। আমি আইএসআইএসের হয়ে হামলা করিনি। সরকার পক্ষ আমাকে যে দলটির সঙ্গে ফেলতে চেষ্টা করেছে, আমি তাদের সমর্থন করি না।’
ম্যানহাটনের আদালতে ৬ নভেম্বর জঙ্গি হামলার দায়ে অভিযুক্ত বাংলাদেশি আকায়েদ উল্লার করুণ আবেদন বিচারক থামিয়ে দিলেন। এক সপ্তাহ শুনানির পর গ্র্যান্ড জুরি আকায়েদকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন। আগামী ৬ এপ্রিল আদালত তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দণ্ড ঘোষণা করবেন। আইন অনুযায়ী ২৮ বছর বয়সী আকায়েদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর সকালের ব্যস্ত সময়ে আকায়েদ উল্লা ম্যানহাটনের পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনালের প্রবেশ পথে নিজের শরীরে বাঁধা পাইপ বোমার বিস্ফোরণ ঘটান বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। বোমাটি ঠিকমতো বিস্ফোরিত হয়নি। প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন তিনি। এ বিস্ফোরণে আহত হন তিন পুলিশ সদস্য। নিউইয়র্কের সর্বত্র জঙ্গি হামলার ভয়ে সতর্ক সংকেত বেজে উঠে। ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দ্রুত ঘটনা জানানো হয়। তিনি এ ঘটনাকে যুক্ত করে তাঁর অভিবাসনবিরোধী বক্তৃতা আরও জোরালো করেন। আমেরিকায় বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের এ ঘটনায় বিব্রত হতে দেখা যায় ।
আহত অবস্থায় আকায়েদকে গ্রেপ্তারের পর নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি হামলা চালানোর চেষ্টা করেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। মামলায় বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা, ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার, জনসমাগমস্থল ও পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থায় সন্ত্রাসী হামলা ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সম্পদের ক্ষতির চেষ্টাসহর ছয়টি গুরুতর অভিযোগ আনা হয় আকায়েদের বিরুদ্ধে। গত জানুয়ারিতে ম্যানহাটনের ফেডারেল কোর্টের গ্র্যান্ড জুরি আকায়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর পক্ষে মত দেয়।
মামলার শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী জুলিয়া গাটো দাবি করেন, আকায়েদ কখনোই আইএস সদস্য ছিলেন না। ‘হতাশাগ্রস্ত’ ওই তরুণ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন আত্মহত্যা করার জন্য। প্রসিকিউটররা ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করে আদালতে বলেন, আকায়েদ তাঁর শরীরে এমনভাবে বোমা বেঁধেছিলেন, যাতে অন্যদেরও ক্ষতি হয়। আর তিনি যে ইন্টারনেটে আইএসের কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর রাখতেন, সেই প্রমাণ তাঁর কম্পিউটারেই পাওয়া গেছে। শুনানি শেষে ছয়টি অভিযোগেই আকায়েদকে দোষী সাব্যস্ত করেন গ্র্যান্ড জুরি।
চট্টগ্রামের ছেলে আকায়েদ বড় হয়েছেন ঢাকার হাজারীবাগে। আট বছর আগে আমেরিকায় আসার পর প্রথমে ট্যাক্সিক্যাব চালালেও পরে একটি আবাসন নির্মাতা কোম্পানিতে বিদ্যুৎ মিস্ত্রির কাজ নেন। দেড় বছরের সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস থাকেন ঢাকায়। ঢাকার জিগাতলার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গত বছর ডিসেম্বরে আকায়েদের স্ত্রী এবং তার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাংলাদেশের পুলিশ। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সে সময় বলেছিলেন, বাংলাদেশে আকায়েদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো রেকর্ড নেই। আমেরিকায় যাওয়ার আগে কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতারও তথ্য মেলেনি।
আমেরিকায় গিয়েই ইন্টারনেটে জঙ্গি কর্মকাণ্ড দেখে আকায়েদ উগ্রবাদী হয়েছেন বলে মনে করা হয়। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান সংগঠক মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর বই পড়ার পরামর্শ দিতেন বলেও সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
হামলার আগে আকায়েদ উল্লা ফেসবুকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে দেওয়া পোস্টে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার জাতিকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছ ট্রাম্প।’
৬ নভেম্বর আদালতে গ্র্যান্ড জুরির রায় ঘোষণার পর আকায়েদ কথা বলতে শুরু করলে বিচারক তাঁকে থামিয়ে দেন। শুনানিতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও শুনানি চলাকালে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো কথা বলেননি। গ্র্যান্ড জুরির রায় ঘোষণার পর বিধ্বস্ত আকায়েদ বলতে শুরু করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ সময় বিচারক রিচার্ড সুলিভান বলেন, বিচারের সময় কোনো বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। আকায়েদ বলতে থাকেন, আমি শুধু স্টেটমেন্ট করছি। বিচারক সুলিভান থামিয়ে বলেন, এখনই এর উপযুক্ত সময় নয়, দণ্ড ঘোষণার সময় স্টেটমেন্ট করা যাবে।
গ্র্যান্ড জুরির পাঁচ দিনের শুনানিতে আকায়েদ যেমন আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য দেননি, তেমনই তাঁর আইনজীবী কোনো সাফাই সাক্ষীও হাজির করেননি। শুনানিকালে সরকার পক্ষ বলেছে, ২০১১ সালে আমেরিকায় আসেন আকায়েদ। আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি এ দেশের প্রতি তার বিদ্বেষ আর ঘৃণা বাড়িয়ে তোলে। জঙ্গি সংগঠন আইএসের প্রতি তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর ল্যাপটপে আইএসের ১০টি ভিডিও পাওয়া গেছে। তাঁর পাসপোর্ট আইএসের পরিচিত স্লোগান লেখা পাওয়া গেছে।
রায় ঘোষণার পর প্রধান প্রসিকিউটর অ্যাটর্নি জিওফ্রি ব্যারম্যান বলেন, ৬ নভেম্বর আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিনে আকায়েদের বিচারের দিন পড়েছে। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমেরিকা গণতন্ত্রের দেশ, এখানে রাজনীতি হয় সহিংসতা নয়, ভোটের মাধ্যমে।
রায়ের পর নিউইয়র্কের পুলিশ কমিশনার জেমস ও নীল বলেন, আকায়েদের বিচার প্রমাণ করেছে নিউইয়র্কের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করার কেউ চেষ্টা করলে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এ নগর কখনো পিছপা হবে না। সহিংসতা নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো আলোচনারই অবকাশ নাই। আকায়েদের আইনজীবী অ্যামি গ্যালিসিও এবং জুলিয়া গ্যাটো রায় ঘোষণার পর সংবাদমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করেননি।
আদালতের বাইরে জুরি বোর্ডের সদস্যরা ছিলেন আবেগাপ্লুত। সবাই বলেছেন, আকায়েদ কিছু স্ক্রু , আর বিস্ফোরকসহ ৯ ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। অন্তত একজন জুরি সদস্য বলেছেন, তিনি মনে করেন আকায়েদ আইএসের হয়ে কাজ করেননি। তবে তিনি কাজটি করেছেন। কেন করেছেন? আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে আকায়েদ তা বললেন না কেন? লিন্ডা আর্টিস নামের জুরি সদস্য এই প্রশ্ন রাখেন। তিনি বলেন, তিনি ১২ সদস্যের জুরি বোর্ডের সঙ্গে একমত হতে সময় নিয়েছেন। ফেডারেল আইনে জঙ্গি হামলাকে বিস্তৃত আকারে সংজ্ঞায়িত করা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সবার সঙ্গে আমি একমত হয়েই রায় দিয়েছি।’
এদিকে ঘটনার পরপরই আকায়েদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। হোমগ্রোন জঙ্গি নিয়ে কমিউনিটিতে উদ্বেগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অনেকেই মনে করেন, তথ্য প্রবাহের এ সময়ে সহজেই বিভ্রান্ত হওয়ার উপাদান হাতের নাগালে। নিজেদের পরিবার এবং আশপাশে নজরদারি বৃদ্ধিসহ সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ থাকলেও কারও কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
নিউইয়র্কেই প্রবাসীদের কয়েক শ সংগঠন। তারাও এসব নিয়ে কোনো প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। নিউইয়র্কে বসবাসরত প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান এ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন, এ সময়ে কোনো মুসলমান অভিবাসীর যেকোনো খেয়ালি কাজ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। আকায়েদ তাঁর কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও অভিবাসন বিরোধীদের হাতে অপবাদের অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। এ নিয়ে প্রবাসী কমিউনিটি নেতাদের করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে।