দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ

ট্রাম্পের উন্মত্ত সমর্থকদের ঠেকাতে ব্যর্থতায় ক্ষোভ, অবিশ্বাস

ক্যাপিটল ভবনে প্রবেশের চেষ্টাকালে এক বিক্ষোভকারীর উদ্দেশে পিপার স্প্রে ছুড়ছেন পুলিশের একজন সদস্য
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে গত বুধবার অনায়াসে ঢুকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত শত উগ্র সমর্থকের তাণ্ডব চালানো, চলতি অধিবেশনে বিঘ্ন ঘটানো ও আইনপ্রণেতাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ অনেক রাজনীতিবিদ। ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে সাধারণ মার্কিনদের মধ্যেও।

বৃহস্পতিবার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ক্যাপিটল (কংগ্রেস ভবন) পুলিশপ্রধান স্টিভেন সান্ডের পদত্যাগ করা উচিত। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট পার্টির এই কংগ্রেস সদস্য আরও বলেন, প্রতিনিধি পরিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কর্মকর্তা সার্জেন্ট–অ্যাট–আর্মস পল ইরভিং এরই মধ্যে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। ইরভিং সরাসরি তাঁর কাছে জবাবদিহি করে থাকেন। সান্ড জবাবদিহি করেন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ উভয়ের কাছে।

সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমারও কম রাগেননি। বলেছেন, ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন সরকারের অভিষেক ও তাঁর (শুমার) সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতার দায়িত্ব গ্রহণের আগেই পদত্যাগ না করলে সিনেটের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাইক স্টেঞ্জারকে বরখাস্ত করবেন তিনি।

ট্রাম্পের সমর্থকেরা বুধবার যেভাবে কংগ্রেস ভবনে ঢুকে হামলা চালিয়েছেন, পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়েছেন, তাতে মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাবেক কর্মকর্তারা নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কীভাবে পুলিশ কংগ্রেসে ওই ঝোড়ো হামলা চালাতে দিতে পারল, সেটি ভেবে সাধারণ মার্কিনদের মতো তাঁদের মনেও জন্ম নিয়েছে অবিশ্বাস।

কংগ্রেসে সদস্যরা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে সত্যায়ন করতে যৌথ অধিবেশনে বসেন, ঠিক তখন ট্রাম্পের উসকানিতে তাঁর সমর্থকদের একটি অংশ মিছিল করে এসে একেবারে ক্যাপিটলের সীমানায় ঢুকে পড়েন।

কিছুক্ষণ পর দুর্বল বেষ্টনী ডিঙিয়ে ও কংগ্রেস ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের পেছনে ফেলে ভবনটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন অনেক ট্রাম্পের সমর্থক। এ সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট, অন্য রাজনৈতিক নেতা ও ভবন কর্মীরা নিরাপদ কক্ষে আশ্রয় নেন। আতঙ্কে তাঁদের কেউ কেউ গ্যাস মাস্ক পরেন। ভবন থেকে সরে যেতে কোনো কোনো বয়স্ক আইনপ্রণেতাকে অন্যদের সহায়তা নিতে হয়।

এরপর ওই সমর্থকেরা ভবনের এখানে–সেখানে ভাঙচুর চালান। সিনেটের মঞ্চে বসে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে এক নারী সমর্থকসহ পাঁচজন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ক্যাপিটল পুলিশ। অথচ সুরক্ষিত কংগ্রেস ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন এ বাহিনীর দুই হাজার সদস্য।

ওই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত কিছু ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, দাঙ্গাকারীরা যখন ভবনে ঢুকছিলেন, তখন কিছু কিছু পুলিশ সদস্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এক পুলিশ সদস্যকে তো ভবনের ভেতরে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে ছবি তুলতে পোজ দিতে দেখা যায়।

নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানোর পরও ট্রাম্পের সমর্থকদের নির্বিঘ্নে ভবন ত্যাগ করতে দিতে দেখা গেছে। আবার বয়স্ক এক দাঙ্গাকারীকে ভবনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে সহায়তা করেন এক পুলিশ সদস্য।

কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধে মেরে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গত বছর শুরু হয়েছিল বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন।

সেই সময় পুলিশকে উল্টো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। অনেকটাই শান্তিপূর্ণ সেসব বিক্ষোভে পুলিশের টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটা সইতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। হতে হয়েছে গণগ্রেপ্তারের শিকারও।

নবনির্বাচিত কংগ্রেস সদস্যদের একজন মনডেয়ার জোনস বুধবার কংগ্রেসের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষোভ ঝেড়ে বলেছেন, ‘এই দাঙ্গাকারীরা যদি কৃষ্ণাঙ্গ হতেন, তবে তাঁদের ক্যাপিটলে ঢোকার আগেই গুলি করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো।’

নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত এই ডেমোক্র্যাট সদস্য বলেন, ‘আমার এমন অনুভূতি জোরালো হওয়ার কারণ ভিডিও ফুটেজগুলো। যেসব সন্ত্রাসী নিরাপত্তাব্যবস্থা ভাঙল, পুলিশ তাদের সঙ্গেই কীভাবে সেলফি তোলে? আবার ওই সন্ত্রাসীদের ভবনে ঢুকতে সহায়তা করতে তারা ধাতব প্রতিবন্ধকতাগুলো সরিয়ে দিয়েছে।’

ক্যাপিটল পুলিশের বাজেট বরাদ্দ দেখভাল করা কংগ্রেস কমিটির চেয়ার টিম রেয়ান বলেন, ওই সমর্থকদের কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার ঘটনায় তিনি হতাশ।

বিশেষত, যখন ক্ষমতার চেয়ারেই তাঁদের বসে পড়তে দেখেন। তিনি আরও বলেন, তাদের তৎপরতা ছিল অবৈধ। তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল।

একই রকমের বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছেন মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাবেক কিছু কর্মকর্তা। তাঁদের একজন কিম ডাইন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্যাপিটল পুলিশের প্রধান ছিলেন তিনি। ডাইন বলেন, ‘এ যেন সত্যিকার ভৌতিক ছবি দেখা। আমরা প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিই, পরিকল্পনা করি, বাজেট বরাদ্দ দিই।

কিন্তু তা এসব দেখার জন্য নয়। এ ঘটনা কীভাবে সম্ভব, আমার মাথায় আসে না।’