গাড়িতে উঠে স্থানীয় রেডিও জিরো সিক্স ছেড়ে দেখুন, কী গান বাজছে? ‘লাস্ট ক্রিসমাস আই গেভ ইউ মাই হার্ট…!’ না হয় এমনই অন্য কোনো গান, যেখানে অবধারিতভাবেই রয়েছে ক্রিসমাস। ডিসেম্বর মাস শুরু হলে সারাক্ষণই রেডিওতে ক্রিসমাসের গান বাজে। সেদিন ব্যাংকে গেলাম একটা কাজে। গিয়ে দেখি ব্যাংকে কর্মরত সবাই সান্তা ক্লজের টুপি পরে আছে। গ্রোসারি শপে গেলাম সেখানেও একই দৃশ্য। ব্র্যান্ড শপগুলোতে তো কথাই নেই। সেখানেও অবিরাম বেজে চলেছে ক্রিসমাসের গান। পুরো নিউইয়র্ক নগরজুড়ে এখন ক্রিসমাসের আমেজ। নানা রঙের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি। আদতে থ্যাংকস গিভিং পার্টি থেকেই ক্রিসমাসের আবহ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। থ্যাংকস গিভিংয়ে চার দিনের ছুটি থাকে আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে। ওই লম্বা ছুটিতে প্রত্যেকে তাঁর বাসায় ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন করে। তারপর সারা মাস চলতে থাকে সাজানোর কাজ। আত্মীয়-বন্ধু প্রত্যেকের জন্য উপহার কিনে সুন্দর করে মুড়িয়ে ক্রিসমাস ট্রিতে ঝুলিয়ে রাখে।
ইস্ট কোস্ট অর্থাৎ আমেরিকার আটলান্টিকের তীরে অবস্থিত শীত-প্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোয় ক্রিসমাস একটু বেশি সাড়ম্বরে আয়োজিত হয়। উত্তরে মেইন, ভারমন্ট,রোড আইল্যান্ড, নিউ হ্যাম্পশায়ার, বোস্টন ও কানেকটিকাট থেকে শুরু হয় এ আয়োজন। তারপর নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলাওয়্যার, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন পর্যন্ত এই অঞ্চল বিস্তৃত। এই এলাকাতে শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। সূর্য মামার দেখা মেলাই ভার হয়ে যায় তখন। আর সূর্য উঠলেও সূর্য রশ্মির তীব্রতা নেই। মানুষ এই সময় কেমন যেন বিষণ্নতাবোধে আক্রান্ত হয়। সেটা কাটাতেই জমকালো করে ক্রিসমাস ট্রি সাজায় প্রত্যেকে ঘরে ঘরে। আলোকসজ্জার ব্যবস্থা থাকে।
প্রতি বছর লং আইল্যান্ডে নিজের বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি সাজান টনি ডায়েস। বাংলাদেশের এক সময়ের সুদর্শন এই নায়ক এখন স্ত্রী প্রিয়া ডায়েস ও মেয়ে অহনা ডায়েসকে নিয়ে থাকেন হিকসভিলে। ’ডেকোরেশন লাইট’ দিয়ে থ্যাংকস গিভিংয়ের ছুটিতেই ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে ফেলেছেন নিজের ঘরে। রং-বেরঙের তারা বানিয়ে তাতে বাতি লাগিয়েছেন। ছোটবেলায় যখন ঢাকায় ছিলেন, তখন লম্বা বাঁশ এনে তাতে লাল-নীল কাগজ বসাতেন। বড় একটা তারা বানাতেন সব সময়। টনি ডায়েস বলেন, ‘এখন নিউইয়র্কে ক্রিসমাসের যত কিছু পাওয়া যায়, বাংলাদেশে ছোটবেলায় আমরা সেসব পাইনি। তবে তাতে আনন্দের কমতি ছিল না। এখন আমার মেয়ে অহনা তো খুব উপভোগ করে ক্রিসমাসের আনন্দ। সকালে উঠে স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত সে কেবল ক্রিসমাসের গান শুনে সময় কাটায়।’
টনি ডায়েসের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেল ‘তারা’ নিয়ে। যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনই হল ক্রিসমাস উৎসব। যিশু জন্মেছিলেন গোয়ালঘরে। প্রাচ্যের জ্ঞানী ব্যক্তিরা উপহার নিয়ে এসেছিলেন শিশু যিশুর জন্য। তারা কিভাবে পথ চিনে এসেছিল? তখন তো পায়ে হেঁটে পথ চলতে হতো মানুষকে। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারার দিকে তাকিয়ে তারা পথ চিনেছিল। যে কারণে ‘তারা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্রিসমাস ট্রিতে।
ক্রিসমাস এখন সর্বজনীন উৎসব। শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীই নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এখন দিনটি পালন করে। খ্রিষ্টান নন এমন অনেকেই বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। নানারকম খাবার-দাবারের আয়োজন করে। নিউইয়র্ক নগরীতে বসবাসরত সংগীত শিল্পী ক্রিস্টিনা ডি রোজারিও জানালেন, ‘২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টায় ক্রিসমাসের প্রথম প্রহরে স্বামী প্যাট্রিক রোজারিওকে নিয়ে উডসাইডে সেন্ট সেভাস্টিন গির্জায় উপস্থিত হই প্রতি বছর। ক্রিসমাসের প্রধান আকর্ষণ হলো নানা ধরনের কেক ও পিঠা। আমরা বাঙালি ধরনেই পিঠা বানাই। বিশেষভাবে তেলের পিঠা ও পাকন পিঠা অবশ্যই থাকে। আবার বাড়িতে পোলাও-রোস্ট রান্না করি এদিন। প্রত্যেকে এখানে নিজের সংস্কৃতি অনুযায়ী খাবার তৈরি করে। তবে কেক সব জায়গায় থাকে।’
ক্রিসমাস ক্যারোল শুরু হয়ে যায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে। এটাকে অনেকে বড়দিনের কীর্তনও বলে। যিশুর বাণী বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হলো এই কীর্তনের বৈশিষ্ট্য। যে বাড়িতে ক্রিসমাস ক্যারলের আয়োজন থাকে, সেখানেও নানারকম খাবারের ব্যবস্থা থাকে। ‘পাবলিক প্লেস’ এ এটা করা হয়। এভাবে পুরো মাসব্যাপী যিশুর বন্দনা চলতে থাকে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে। ক্রিসমাস উৎসবের আরেকটা ভালো দিক হলো, সবাইকে উপহার দেওয়া, তা যত ছোটই হোক। উপহার একটা চকলেটও হতে পারে। সেটাকে সুন্দর কাগজে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। উপহারটা আসলে প্রতীকী। আসল হলো আনন্দকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। ক্রিসমাসের আগেই সব উপহার ক্রিসমাস ট্রির নিচে সাজিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বরের আগে কেউ তা খোলে না। ছোট্ট শিশুদের বলা হয়, তোমরা যদি ভালো হয়ে চল সারা বছর, তবেই সান্তা তোমাদের জন্য উপহার নিয়ে আসবে। নয়তো কিছু আনবে না।
ক্রিসমাস আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে রমরমা ব্যবসার সময়, যা থ্যাংকস গিভিং ও ব্ল্যাক ফ্রাইডে দিয়ে শুরু হয়। তারপর আসে সাইবার মানডে। এ কেনাকাটার উৎসব চলতে থাকে পুরো ডিসেম্বরজুড়ে। সর্বত্র ‘সেল’ থাকে এই সময়। ক্রিসমাসের পরে আসে ‘নিউ ইয়ার’ উদ্যাপনের আনন্দ। কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষ নেই যে এ সময় একে অন্যকে উপহার কিনে দেয় না! বাঙালি ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষকদের উপহার দেয়। যে স্কুলবাসে করে প্রতিদিন যাতায়াত করে, তার ড্রাইভার-অ্যাটেনডেন্টকেও উপহার দেওয়া হয়। কারণ এটা হলো উপহার আদান-প্রদানের মৌসুম। ব্যবসায়ীদের আনন্দের কারণ তো এটাই।