আজ প্রায় এক মাস আমরা শুধু বাংলা নাটক দেখছি। টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের আজ রবিবার, বহুব্রীহি এসব দেখি। দেখি নক্ষত্রের রাত। দেখি আর মিশে যাই হারিয়ে যেই সেই ফেলে আসা দিনে। কাল এগিয়ে যায় তার আপন গতিক্রমে।
নদীর মতো চলমান মানুষের জীবন। সেখানে মানুষের সুখ আছে, দুঃখ আছে। সুখ মানুষকে আপ্লুত করে। সুখী মানুষের স্বপ্নগুলো ভিন্নধারায় বয়ে যায়। সুখী নীলগঞ্জের স্বপ্ন দেখেন তারা। আর দুঃখী মানুষের দুঃখগুলো যেন কুয়ার মতো। যার যত দুঃখ, তার কুয়া তত গভীর।
একজন হুমায়ূন আহমেদ যেন একজন দার্শনিক। মধ্যবিত্তের জীবন তার নাটকে তিনি এত চমকপ্রদভাবে তুলে আনতেন, আমরা এর চরিত্রগুলো যেন প্রতিদিনকার জীবনে দেখতে পেতাম। আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটা পর্বে যে সব চরিত্র দেখি, তারই চিত্রায়ণ দেখি নাটকে। নাটক দেখতে গিয়ে নাটক আর নাটক থাকে না যাপিত জীবনের পরতে পরতে দেখি নাটককে। নন্দিত নরকে প্রথম যখন বিটিভিতে দেখি, তখন বয়স কম ছিল। এখন যখন আবার দেখি আমি একজন শক্তিমান চিত্রকরকে দেখি। অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখি কীভাবে তিনি এত নিখুঁতভাবে প্রতিটা মানুষকে চিত্রায়ণ করেন। অবলীলায় রাবেয়ার মতো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে ভুল করে। মাস্টার চাচার মতো পুরুষ সুযোগ নেয়। সংসার আর সংসার থাকে না। মন্টু সব বুঝে যায়, আর মাস্টার চাচাকে কুপিয়ে খুন করে জেলে যায়।
আজ রবিবার, বহুব্রীহি বা নক্ষত্রের রাত হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অয়োময় হয়ে ওঠে প্রতিদিনকার জীবনলিপি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। রোকেয়া হলে থাকি। হলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সে এক এলাহি কাণ্ড। স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল সব। রুপালি পর্দা বা পর্দার অন্তরালের যে সব মানুষ, তাদের বিচারক হয়ে আসতে শুনে আমাদের অবস্থা যেন কী করি, কী না করি। গানের শিল্পী, নাচের শিল্পী, নাট্যজগতের, লেখালেখির জগতের। আসেন শিল্পী, যারা রুপালি পর্দার আলো ছড়াতেন। নিজেকে দারুণ সৌভাগ্যবান মনে করতাম, আমরা তাদের বিনা পয়সায় হাতের নাগালে দেখতে পাচ্ছি।
প্রথম তাঁকে দেখেছি রোকেয়া হলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ‘ধারাবাহিক গল্প বলা’ অনুষ্ঠানে। আমরা সামনের দিকের সারিতে বসেছি। গল্পের শুরুর মুখটা বলে দিয়ে আসলেন। গল্পের নায়ক আনিস। বক্তারা গল্প চালিয়ে কিছু দূর টানতে না টানতেই এক প্রতিযোগী কাঁচপুর ব্রিজে গাড়িচাপা দিয়ে আনিসকে মেরে ফেলল। অনুষ্ঠানের শেষে বিচারকমণ্ডলীর রায় ঘোষণার আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি খুব মর্মাহত হয়েছেন। ধারাবাহিক গল্পের মূল লক্ষ্য হলো ধারাবাহিকতা। গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়া। শুরুতেই নায়কের মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। আনিস নামের তরুণকে পেয়ে তরুণীরা তাকে কতটা স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেটাই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তবে প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আগের বক্তার নায়কের মৃত্যু ঘটানোকে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন বললেন যে পরবর্তী বক্তা, তাকেই গল্পের টার্নিং পয়েন্ট বললেন হুমায়ূন আহমেদ।
আমাদের সিনিয়র এক আপা ছিলেন সেই টার্নিং পয়েন্টের বক্তা। আর তিনিই প্রথম হয়েছিলেন। একজন হুমায়ূন আহমেদ, যিনি কিনা কোন গায়ক নন, নায়ক নন, বাচনভঙ্গি তত আকর্ষণীয় নয়, দেখতেও আহামরি সুদর্শনও নন। কিন্তু মিলনায়তন ভর্তি মেয়েরা পিনপতন নীরবতায় একজন হুমায়ূন আহমদকেই শুনছিল। আমরা অবাক বিস্ময়ে একজন গল্পকার নাট্যকারকে দেখছিলাম।
এর বহুদিন পর, মনে হয় বছর তিনেক হবে, বিয়ের পরপর ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছি পারাবত নামের এক্সপ্রেস ট্রেনে। ঝকঝকে সুন্দর আন্তনগর রেল। টিকিট অনুযায়ী আসন খুঁজে নিতে সময় লাগল না। আমরা একটু আগেভাগেই চলে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর অন্য সহযাত্রীরা আসতে শুরু করল। আর আমাদের পাশে যারা এসে বসলেন, তাদের দেখে আমাদের চোখ কপালে ঠেকার অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন আহমেদ, বিপাশা, শিলা আর নোভা আমাদের বগিতে এসে বসেছেন! আছেন ওবায়দুল ইসলাম আর তার মেয়ে দীপা ইসলাম। আমাদের পাশেই তাদের আসন।
যথাসময়ে ট্রেন সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হল। বাইরে ঝকঝকে রোদ। কিছুক্ষণ পর দুটি স্যুটকেসের ওপর একটা বোর্ড পেতে কার্ড খেলার আয়োজন হলো। তখনই হাসিমুখে কথা বললেন ওবায়দুল ইসলাম। তিনি তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক নাটকে কমলা চরিত্রে তখন দীপা অভিনয় করছিল। শিলা, নোভা, বিপাশারা যার যার ছোট ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বসেছে। গুলতেকিন খুব অল্পবয়সী, মেয়েদের বন্ধুর মতোই লাগছে।
হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু কার্ড খেললেন না। তিনি কোনায় জানালার পাশের আসনে বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বসে রইলেন। পারাবত ট্রেন যখন আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দুপাশে গাঢ় সবুজ দীর্ঘ ছায়াবৃক্ষ ঢাকা ছোট ছোট চায়ের গাছ। তিনি যেন ভারী কাচের ভেতর দিয়ে চা গাছের সেই সৌন্দর্যকে নিজের ভেতর নিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি যেন জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য মনের মানসপটে এঁকে নিচ্ছেন।
সেবার সপরিবারে হুমায়ূন আহমেদরাও সুনামগঞ্জে জোছনা দেখতে যাচ্ছিলেন। ভরা বন্যার পানিতে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার চাঁদ কী যে রূপসী করে তোলে শহরটিকে, তা যে দেখেনি সে বুঝবে না।। পৌর মেয়র মমিনুল মউজদিন শহরের সব বাতি নিভিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আর সে শহরে ছেলে বুড়ো সবাই আসমান ভাঙা জোছনা দেখত। কতটা জোছনাবিলাসী হলে হাওরের শহরে জোছনা দেখতে পুরো পরিবার নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন।
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো এক বরষায়’
যে চলে যায়, সে আর আসে না। এত কী তাড়া ছিল যাওয়ার কে জানে আমরা তাঁর সৃষ্টিকে অনুধাবন করে বেঁচে থাকার আনন্দ কুড়াব।