কেউ ভাবেনি। কেউ না। সাহারা খান নিজেও কি ভাবতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে হবেন নিউইয়র্কের চালু রেস্টুরেন্টের চিফ শেফ। মাত্র ১৪ বছরে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া হয়নি। বাংলাদেশে থাকতে কোনো দিন এক টাকাও আয় করেননি তিনি। যৌথ পরিবারে রান্না করা ও সন্তান লালন–পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল জীবন। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসেও ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। সেই যৌথ পরিবার আর দিনভর ঘর–সংসারের কাজ করা। স্বামীর একার আয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে নিউইয়র্ক শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। সংসারের হাল ধরতে একসময় সেই গৃহবধূ জ্যাকসন হাইটসে এক আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজ নিলেন। দিন গড়াতে লাগল। একদিন সেই গৃহবধূ হয়ে গেলেন রেস্টুরেন্টের ‘চিফ শেফ’।
অ্যাস্টোরিয়ার থার্টি সিক্স অ্যাভিনিউয়ের ওপরে অবস্থিত রেস্টুরেন্টটির নাম ‘বৈশাখী’। বাঙালিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কারণ, ওখানে যেন মায়ের হাতের রান্না খেতে পাওয়া যায়। চিফ শেফ সাহারা খানের চেহারা আর হাসি দেখলে মায়ের কথাই মনে হবে আগে। সাহারা খান হলেন সেই মা, যিনি পরের রেস্টুরেন্টে ১২ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে এই শহরে বড় করেছেন ছেলেমেয়েদের। এক সময় ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হয়। তখন ওদেরকে বলেন, কত দিন আর অন্যের রেস্টুরেন্টে চাকরি করব? তোরা নিজেরা কিছু কর। ২০১৫ সালে ছেলে তানজিল ও মেয়ে রিমি শামসুন এবং মেয়ের জামাই আতিফ মিলে কিনে নিল অ্যাস্টোরিয়ার এই রেস্টুরেন্টটি, যেটি এর আগে আঠারো বার হাত বদল হয়েছে। কিন্তু কোন মালিকই লাভের মুখ দেখেনি। কিন্তু বাঙালি কমিউনিটিতে ‘বৈশাখী’ রেস্টুরেন্ট এখন জনপ্রিয় একটি নাম। আর রেস্টুরেন্টের জনপ্রিয়তার পেছনে প্রধান কারণ যে তাঁর রান্না করা খাবার, সেটা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার নেই।
শুধু বাঙালি কমিউনিটির কথা বলি কেন, অ্যাস্টোরিয়ার অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতি থেকে আসা মানুষের কাছেও ‘বৈশাখী’ একটি জনপ্রিয় নাম। প্রমাণ পেলাম আমার স্কুলের পার্টিতে। অ্যাস্টোরিয়ায় আমি যে স্কুলে চাকরি করি, তার প্রিন্সিপাল একই প্রতিষ্ঠানের ব্রুকলিনের স্কুলে বদলি হয়ে গেছেন। তার বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত পার্টিতে সবাই যে যার মতো ডিশ নিয়ে আসল। ‘বৈশাখী’ রেস্টুরেন্ট থেকে আমি সবার জন্য শিক কাবাব নিয়ে গেলাম। মজার ব্যাপার হলো, স্কুলে আরও একজন যে বাঙালি আছে, সেও বৈশাখী রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিল। ও নিয়েছিল ‘বাটার চিকেন’। সবাই তো আমাদের খাবার খেয়ে মুগ্ধ। দুজন বলল, তারা আগেই ওই রেস্টুরেন্টে গেছে। অনেকে রেস্টুরেন্টের ঠিকানা নিল। আমার কাছ থেকে যখন শুনল, সাধারণ একজন গৃহবধূ, যার রান্নার ওপর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, উনি রেস্টুরেন্টের চিফ শেফ, খুবই অবাক হলো। একজন তো বলে ফেলল, ‘আসলে কার কী প্রতিভা আছে, আমরা বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারি না!’
বাংলাদেশে থাকতে বিষয়টা অতটা বুঝতে পারতাম না। আমেরিকায় এসে জানলাম, চিফ শেফ এ দেশে অনেকটা সেলিব্রেটির মতো। হলিউডে বহু সিনেমা আছে চিফ শেফদের নিয়ে। ক্যাথরিন জেটা জোন্স, ব্র্যাডলি কুপারের মতো সেলিব্রেটিরা সেই সব সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বৈশাখী রেস্টুরেন্টের চিফ শেফকে দেখে অবশ্য সেলিব্রেটি মনে হবে না। বাংলাদেশের মা-খালাদের মতোই চেহারা ও ব্যবহার। কথা বলেন নম্র স্বরে। কথায় কথায় জানলাম, সাহারা খানের জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বালুশাইর গ্রামে। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। স্বামী খোরশেদ মিয়া ১৯৮৯ সালে ও পি–ওয়ান ভিসা পেয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সাহারা খান থেকে যান বাংলাদেশে। খোরশেদ মিয়া ভিনদেশে নিজেকে গুছিয়ে নেবার পরে ১৯৯৭ সালে স্ত্রী-সন্তানদের নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। সংসারের আয়ে স্বামীকে সাহায্য করার জন্য এক আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে চাকরি নেন সাহারা খান। এখন জ্যাকসন হাইটসে যেখানে সবজি মন্ডি অবস্থিত, সেখানে আগে ছিল ‘আলাউদ্দিন’ রেস্টুরেন্ট। ওখানে এবং পরে হাটবাজারে দীর্ঘদিন শেফের কাজ করেন সাহারা খান।
একান্নবর্তী পরিবারে সাহারা খানের রান্নার প্রশংসা আগে থেকেই ছিল। ১৯৭৪ সালে বিয়ের পরে ঢাকার শাহজাহানপুরে থাকতেন। যেকোনো রান্না খুব সহজে আয়ত্ত করে ফেলার অসাধারণ গুণ ছিল তাঁর। নিউইয়র্কে এসে শেফের চাকরি নিয়ে অন্যদের রান্না করা দেখতেন। কারি, তন্দুরি, এপিটাইজার আলাদাভাবে রপ্ত করেছেন। এভাবে জীবনের পাঠশালায় ছাত্র তিনি। অন্যের রেস্টুরেন্টে ১২ ঘণ্টা চাকরির পর আবার ঘরে ফিরে সব কাজ করতে হতো। এলমহাস্টে এক বেড রুমের বাসায় স্বামী-সন্তান ছাড়াও শ্বশুর–শাশুড়ি থাকতেন! জীবন ছিল অনেক সংগ্রামের। রেস্টুরেন্টের মালিকেরা ঠিকমতো মজুরি দিতে চাইতো না। কিন্তু সাহারা খান ধৈর্য ধরেছেন। যার প্রতিদান তিনি পেয়েছেন। তবে এত দূর যাবেন সত্যি ভাবেননি, ‘এত বড় প্রতিষ্ঠান হইব, কোনো দিন সেটা চিন্তা করি নাই।’
যে মানুষ বাংলাদেশে কোনো দিন এক টাকাও আয় করেননি, তিনি নিজের আয়ের ডলার দিয়ে ঢাকার বনানী ও উত্তরায় ফ্ল্যাটে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। নিউইয়র্কের ওজোন পার্কে ছেলেমেয়েরা যে বাড়ি কিনেছে, তার অন্যতম অংশীদার তিনি। নিজেদের রেস্টুরেন্ট হওয়ায় এখন অনেকটা নির্ভার সাহারা খান। বাসায় গিয়ে রান্নার ঝামেলা নেই। কারণ সারা দিন তো এখানেই কেটে যায়। সাহারা খানের সঙ্গে কথা যখন বলছিলাম, তখন এই রেস্টুরেন্টের ভর্তা নেওয়ার জন্য এসেছিলেন শিল্পী তাজুল ইমাম ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না ইমাম। এখানকার দেশীয় খাবার খুব জনপ্রিয়, সেটা রেস্টুরেন্টের নিচতলায় নিয়মিত বিভিন্ন পার্টির আয়োজন থেকে বোঝা যায়। পিকনিকসহ নানা অনুষ্ঠানেও এখান থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। রিমি শামসুনের কাছে জানা গেল, কিছুদিন আগে নরসিংদী জেলার পিকনিকে তাদের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়েছিল ওরা। সবাই এত প্রশংসা করেছে মায়ের খাবারের যে, বলার মতো নয়!
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার মুখে চক্ষু চড়কগাছ। আমার আগেই নিউইয়র্ক টাইমস ২০১৭ সালে রিপোর্ট করেছিল বৈশাখী রেস্টুরেন্ট নিয়ে। যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আর কেউ নন, চিফ শেফ সাহারা খান। লেখক লিজায়া মিশান শুরুতেই লিখেছেন, এখানকার খাবার আলাদাভাবে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরে। যেটা ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো নয়। লেখক এখানকার শুঁটকি ভর্তা ও শিম ভর্তা খেয়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পরে এই লেখাটা না লিখে পারেননি।