বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রায় ১৫ বছরের মাথায় তাঁর মামলাটি সচল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। এত দিন পর মামলা সচল করার সিদ্ধান্ত অভিবাসন আইনে অস্বাভাবিক নয়। আইনজীবীরা মনে করছেন, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অন্যদের কাছে কঠিন বার্তা যাবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েই অনেকেই মনে করেন, তাঁদের সব পাপ মুছে গেছে। এবার তাঁদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
আমেরিকার অভিবাসন আইনে এমন তথ্য দিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও তা কেড়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ের নামে বহু খুনি ও অপরাধী আমেরিকায় এসে আশ্রয় লাভ করেছেন। নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করছেন। রাশেদ চৌধুরীর মামলার তলবের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ–সংক্রান্ত অবস্থানই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ঠিক কী উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে গত ১৭ জুন উইলিয়াম বার এক চিঠিতে এ এম রাশেদ চৌধুরীর আদ্যক্ষর ‘এ-এম-আর-সি’ সংক্রান্ত নথি পাঠাতে ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
আমেরিকার অভিবাসন আদালত বিচার বিভাগের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রশাসনিক আদালতের এসব আশ্রয় অনুমোদন বা অভিবাসনের যেকোনো মামলার সিদ্ধান্তে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল ক্ষমতা আরোপ করতে পারেন। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের আদেশের পরও ক্ষুব্ধ জনগণ ফেডারেল আদালতে যেতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ থেকে খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ডিপোর্ট করার আদেশ দেওয়া হলে তিনিও ফেডারেল আদালতে যেতে পারবেন।
আমেরিকার অভিবাসন আদালতগুলোয় হাজারো মামলা পড়ে আছে। বিচারকসংকটের কারণে মানুষকে বছরের পর বছর আশ্রয় আবেদনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন করেছেন—এমন একজন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসন আদালতে প্রথম শুনানির জন্য তারিখ পেয়েছেন ২০২২ সালের শেষের দিকে।
আবেদনের প্রায় ১০ বছর পরে রাশেদ চৌধুরীর আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর হয়েছিল। শুরুতে অভিবাসন আদালত রাশেদ চৌধুরীর আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর করেননি। পরে আপিল করে ‘বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপিল’ থেকে তাঁর আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর করা হয়। রাশেদ চৌধুরীর অভিবাসন শুনানিতেই পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড এবং এ–সংক্রান্ত মামলায় তাঁর দণ্ডের ফিরিস্তি উঠে আসে। আপিল বোর্ড থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর করা হলেও তখনই বোর্ড থেকে অভিবাসন বিভাগের বিচারকের কাছে একটি নোট পাঠানো হয়। বোর্ড অব আপিল থেকে বলা হয়েছিল, রাশেদ চৌধুরীর আবেদন মঞ্জুরের মধ্য দিয়ে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবীরা তখন মামলা মঞ্জুর হয়েছে ধরে নিয়ে এ নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপে যাননি। ২০০১ সালের পর মার্কিন কংগ্রেসে প্রণীত অ্যান্টিটেররিজম আইনে এমন আশ্রয় আবেদনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার অনেক উপাদান আছে বলে জানিয়েছেন একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবী।
মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দণ্ডিত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাপক লবিং শুরু হয়। এ নিয়ে ২০১৬ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি লেখাও প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমসে।
পলিটিকোর দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এ নিয়ে আবারও অনুরোধ করেন গত এপ্রিল মাসে। আমেরিকান ইমিগ্রেশন ল ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরমি ম্যাককিনি বলেছেন, এ পদক্ষেপ আমেরিকায় থাকা এ ধরনের অভিবাসীদের একটি কঠিন বার্তা প্রদান করবে। আশ্রয় আবেদনের সুরাহার এক যুগ পরও কোনো কোনো মামলা আবার খতিয়ে দেখাটাকেই কঠিন বার্তা মনে করছেন এসব আইনজীবী। অভিবাসনের এমন আবেদনের কোনো সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত নয়, ফিরে দেখার সুযোগ আছে—এ বার্তাই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে পাচ্ছেন অভিবাসী আইনজীবী ও আশ্রয় আবেদনের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষ।
এমন পদক্ষেপ আইনে থাকলেও আগে এর কোনো প্রয়োগ দেখা যায়নি। অভিবাসন আইনজীবীরা বলছেন, রাশেদ চৌধুরীর মামলা আবার খতিয়ে দেখার মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকায় আশ্রয় আবেদন অপব্যবহার যাঁরা করেছেন, তাঁদের কাছে কঠিন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মামলাটি সচল করার পর রাশেদ চৌধুরীর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে বহিষ্কার করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করাটা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে। এমন সংবাদে আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। অনেকেই তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন, এমন সংবাদ তাঁদের জন্য সব সময় পীড়াদায়ক। অপরাধীর অভয়ারণ্য না হয়ে আমেরিকা ভালো মানুষের অভয়ারণ্য হয়ে উঠুক—এ কথাই এখন বলছেন প্রবাসীরা।