অস্বাভাবিক ব্যাংকঋণের বোঝা নিউইয়র্কের ট্যাক্সি চালকদের একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ট্যাক্সি মেডেলিয়ন মালিকদের ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোর নামে তদন্ত শুরু হয়েছে এখন। নেওয়া হচ্ছে মেডেলিয়ন মালিকদের সংকট থেকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ।
নগর পরিকল্পনাকারী গ্যারি রথ ২০১০ সালে নিউইয়র্ক নগরীর ট্যাক্সি-নীতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। খুব দ্রুতই
তিনি নিউইয়র্কের ট্যাক্সি পেশায় জড়িতদের নানা সংকট শনাক্ত করতে শুরু করেন। চরম অনিয়মের খোঁজ পান তিনি। তিনি দেখেন, নিউইয়র্ক নগরীতে প্রয়োজনীয় অনুমোদনসহ একটি ট্যাক্সি ক্যাবের মালিকানা পেতে ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই এ ব্যয় ২ লাখ ডলার থেকে বেড়ে ৭ লাখ ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ফলে ক্যাব মালিকদের মেডেলিয়নের মালিকানা পাওয়ার জন্য শরণাপন্ন হতে হচ্ছে ব্যাংকের। ব্যাংকঋণ ছাড়া তাদের পক্ষে একটি ট্যাক্সির মালিকানা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এই ব্যাংকঋণই তাঁদের আটকে ফেলে এক ভয়াবহ চক্রে, যা থেকে তাদের মুক্তি সহজে মেলে না।
এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রথ। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা সেই সময়েই সতর্ক করেছিলেন যে, এ ব্যাপারে নগর প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নিলে ব্যাংকঋণগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হতে সময় লাগবে না। এর প্রভাব পড়বে নগরীর অর্থনীতিতে। রথের এই সতর্কবার্তা ফলতে সময় লাগেনি। গত কয়েক বছরে একের পর এক ক্যাবির আত্মহত্যার ঘটনাই এর প্রমাণ।
সেই প্রতিবেদন রথ ও তাঁর দল শুধু ট্যাক্সি মেডেলিয়ন সম্পর্কেই নয়, সার্বিক বিষয়েই আলবেনির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, ট্যাক্সি মালিকেরা তাঁদের ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট আয় করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো এই ঋণ থেকে বেশি মুনাফা করার চেষ্টা করছে। বিষয়টি ফেডারেল তদন্তেও বেরিয়ে আসে। কিন্তু এর কোনো কিছুই ধর্তব্যে নেয়নি প্রশাসন। ২০১৪ সালের শেষ দিকে মেডেলিয়নের দাম বেড়ে ১০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ অতি উচ্চ মূল্য হাজার হাজার অভিবাসী চালকদের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় সে সময়েই। আজ নিউইয়র্কের ক্যাবিরা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তার শুরু বলা যায় সেই সময়েই। অথচ তখন মেডেলিয়নের এই মূল্য বৃদ্ধিকে ট্যাক্সি শিল্পের রমরমা হিসেবে দেখা হয়েছিল। কয়েক বছর ধরে সতর্ক করার পরও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো এ পতন রোধে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বরং এ মেডেলিয়ন বিক্রয় করে মুনাফা পেতে অতি উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। ট্যাক্সি শিল্পের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগের কারণে তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করেছিল বলে মন্তব্য করা হয়েছে ১৯ মে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে।
সাবেক অর্ধশতাধিক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সরকারি নথি বিশ্লেষণ করে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ট্যাক্সি শিল্পকে রক্ষায় ও এ খাতে যেকোনো ধরনের অনিয়ম রোধে যে তদারকি সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তারা গুটিকয় ব্যাংকার ও মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে মিলে বাজারকে লাগামছাড়া করে দেয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খাতের ওপর তদারকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগসাজশেই আজকের এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কের সবচেয়ে পরিচিত প্রতীকে পরিণত হওয়া হলুদ ক্যাবের হাজার হাজার অভিবাসী চালক আজ আর্থিক ফাঁদে আটকা পড়েছেন। অন্তত ৯৫০ জন চালক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। আরও অনেকেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিউইয়র্কের ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশনে ২০০৭-১৬ সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা ডেভিড ক্লাহর বলেন, ‘কেউই এই শিল্পকে বিপর্যস্ত করতে চায়নি। কেউই এই সোনালি হাঁসকে হত্যা করতে চায়নি।’
কিন্তু বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, নগরীর প্রশাসনই এই অবস্থার জন্য দায়ী। সাবেক দুই মেয়র রুডলফ জুলিয়ানি ও মাইকেল আর ব্লুমবার্গ ট্যাক্সি ও লিমোজিন কমিশনে নিজের রাজনৈতিক সহযোগীদের যুক্ত করেন। বাজেট সমন্বয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন তহবিলের অর্থ সংকুলানের জন্য ট্যাক্সি মেডেলিয়নের মূল্যকে লাগামছাড়া করে দেন তাঁরা। এই ধারা অব্যাহত থাকে বর্তমান মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর সময়েও। ব্লুমবার্গ ও ডি ব্লাজিওর অধীনে ট্যাক্সি মেডেলিয়ন বিক্রি ও এর ওপর কর আদায় করে ৮৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারেরও বেশি আয় করেছে প্রশাসন।
এই সময়েই ২০০৮ সালের বন্ধকি ঋণ সংকটের মতো করে এই শিল্প-সংশ্লিষ্ট একটি অংশ কৃত্রিমভাবে মেডেলিয়নের দাম বাড়িয়ে দেয়। তারা মেডেলিয়ন ক্রেতাদের যতটা সম্ভব ঋণ নিতে উৎসাহিত করে। যখন মেডেলিয়ন বাজার ভেঙে পড়ে, তখন সরকার এ সংকট নিরসনে কোনো কাজ করেনি।
নিউইয়র্কের ক্যাবিদের একটি বড় অংশই অভিবাসী। বাংলাদেশি অনেক অভিবাসীর একমাত্র উপার্জনের খাত এই ক্যাব চালনা। কিন্তু অত্যধিক ব্যাংকঋণের চাপে তাঁরা এখন পিষ্টপ্রায়। বিশেষত গত কয়েক বছরে যারা মেডেলিয়ন কিনেছেন, তাঁদের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। উবার ও লিফটের মতো অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা চালুর পর ক্যাবিদের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপ। ফলে ক্যাবিরা না পারছেন তাঁদের মেডেলিয়ন বিক্রি করতে, না পারছেন ঋণ পরিশোধ করতে। পেশা পরিবর্তন করাও এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
প্রশাসন সাম্প্রতিক সময়ে পুরো সংকটের কারণ হিসেবে উবার ও লিফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তাকে দায়ী করলেও আদতে বিষয়টি এতটা সরল নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, নগরীর ট্যাক্সি চালকদের এই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার দায় কেউ নিতে চাইছে না। অথচ এরা সবাই মিলেই সংকটটি তৈরি করেছে। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয়, তখন তারা একজন আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপায়। টিএলসি কর্মকর্তারা ঋণের নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নয় বলে এড়িয়ে যান। তাঁদের ভাষ্য, ঋণের বিষয়টি ব্যাংকের আওতাধীন। নিউইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অব ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বলেছে, ট্যাক্সি শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি ব্যাংকের কার্যক্রম তদারকির সময় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ফেডারেল তদন্তকারীদের সঙ্গে তাদের মতদ্বৈধতা হয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রেডিট ইউনিয়ন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনসিইউএ) বলেছে, ঋণদাতারা ঋণগ্রহীতাদের চাহিদা মেটাতে কাজ করছেন। গত মার্চে সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তদারককারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এমনকি সেই প্রতিবেদনও সরকার গিলে খেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যাক্সি শিল্প তদারকির সঙ্গে জড়িতরা এর ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।
টিএলসি মোটাদাগে ১২ হাজার মেডেলিয়ন চালক ও ফ্লিটের তত্ত্বাবধান করে। তারাই লাইসেন্স দেয় এবং ক্যাবগুলোর সড়কে নামা, রুট নির্ধারণ থেকে শুরু করে সার্বিক তত্ত্বাবধান করে। নগরীর চাহিদা অনুযায়ী পুরো বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব কমিশনের। কিন্তু ব্লুমবার্গের সময়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে হুট করে ১ হাজারটি নতুন মেডেলিয়ন বাজারে আনা হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, শহরের পরিসর বাড়ছে, তাই নতুন হলুদ ক্যাব প্রয়োজন। এই মেডেলিয়ন বিক্রির আগে এমনকি টেলিভিশনে, রেডিওতে, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেমিনারেও বলা হয়, ‘এই মেডেলিয়ন কেনার সুযোগ জীবনে বারবার আসবে না।’ হু হু করে বাড়তে থাকে মেডেলিয়নের দাম।
সে সময় প্রচার চালানো হয়, মেডেলিয়ন নিশ্চিত কর্মসংস্থানের পাশাপাশি হোম ফাইনান্সিং, কলেজ টিউশন, এমনকি ‘উদ্বেগ মুক্ত’ অবসর গ্রহণে সহায়তা করতে পারে। ২০০৪ সালে ব্লুমবার্গের অধীনে প্রথম নিলামের বিড ছিল ৩ লাখ ডলারের বেশি, যা বিশেষজ্ঞদেরও বিস্মিত করেছিল। কয়েক দশক ধরে ট্যাক্সি শিল্পকে কেন্দ্র করে একটি ব্যাংকিং সিস্টেম গড়ে উঠেছিল। মেডেলিয়ন ঋণের কাজে বিশেষ সহায়তা দিতে প্রায় অর্ধ ডজন অলাভজনক ক্রেডিট ইউনিয়নও কাজ করছিল। তারা অর্থ উপার্জনের জন্য একটি ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করেছিল। এই পথ ধরেই মেডেলিয়নের দাম অত্যধিক বেড়ে যায়, আর ক্যাবিরা আটকা পড়েন এক ভয়ংকর ঋণজালে।
নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ২০ মে বলেছে, তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঋণের দায়ে জর্জরিত হওয়া ক্যাব চালকদের সংকট নিরসনে তারা কাজ শুরু করেছে। এদিকে মেয়র বিল ডি ব্লাজিও আরেকটি পৃথক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব মধ্যস্বত্বভোগী ঋণ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের এ তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
সিটি কাউন্সিলম্যান মার্ক লেভিন বলেন, তিনি একটি খসড়া বিল তৈরি করছেন, যা ঋণদাতাদের কাছ থেকে মেডেলিয়ন ঋণ কিনে নিতে নগরীকে অনুমোদন দেবে। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের ঋণের বেশির ভাগই ক্ষমা করে দেওয়ার প্রস্তাব তোলা হবে।
নগর পরিষদের স্পিকারের মুখপাত্র বলেন, টাস্কফোর্সের সদস্যরা খুব শিগগিরই নিযুক্ত হবেন। তিনি ট্যাক্সি ও লিমোজিন কমিশনের সমালোচনা করে বলেন, ‘সঠিকভাবে সব তথ্য সন্নিবেশিত করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ঋণদাতা, মেডেলিয়ন বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও ফ্লিট পরিচালকদের সহকারীদের হাত থেকে চালকদের রক্ষা করতে সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে।